Dhaka Reader
Nationwide Bangla News Portal

মোবাইল ফোন বিক্রিতে মন্দা, কমেছে উৎপাদনও

55

দেশে মোবাইল ফোন বিক্রি কমেছে। এরফলে কমেছে স্থানীয়ভাবে মোবাইল ফোন উৎপাদনও। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে সাড়ে পাঁচ লাখ মোবাইল ফোনের উৎপাদন কম হয়েছে। এর মধ্যে বেশি কমেছে স্মার্টফোনের উৎপাদন। একই সময়ে বিদেশ থেকে মোবাইল ফোনের আমদানিও নিম্নমুখী। বিটিআরসির সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বরে দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন হয়েছিল ২৪ লাখ ৩২ হাজার। ডিসেম্বরে উৎপাদন হয়েছিল ২১ লাখ ১০ হাজার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সেই সংখ্যা নেমেছে ১৮ লাখ ৯২ হাজারে। অর্থাৎ তিন মাসে ৫ লাখ ৪০ হাজার মোবাইল ফোন উৎপাদন কমেছে। সর্বশেষ তিন মাসে স্মার্টফোনের উৎপাদন বেশি কমেছে।

গত নভেম্বরে দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ২৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ ছিল স্মার্টফোন। জানুয়ারিতে সেই অনুপাত কমে ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশে নেমেছে। একই সময়ে ফিচার ফোন (টু-জি) উৎপাদন বেড়েছে। নভেম্বরে ফিচার ফোনের উৎপাদনের হার ছিল ৭১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। জানুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক ২০ শতাংশ। অন্যদিকে বিদেশ থেকে আমদানি করা মোবাইল ফোনের সবই স্মার্টফোন। বিটিআরসির প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ৯টি ফোর-জি এবং ১০ হাজার ফাইভ-জি স্মার্টফোন আমদানি করা হয়েছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা আরও কমেছে। ওই মাসে মাত্র পাঁচ হাজার ৫০টি ফাইভ-জি মোবাইল ফোন আমদানি করা হয়েছে।

তবে উৎপাদন কমলেও মানুষের হাতে মোবাইল ফোন সেটের সংখ্যা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে অবৈধ পথে আসা মোবাইল ফোনগুলোকে চিহ্নিত করছেন প্রযুক্তিসংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমআইওবি) বলছে, দেশে অবৈধভাবে মোবাইল হ্যান্ডসেট বা ফোন আমদানি বন্ধ না হওয়ায় স্থানীয় বাজারের প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ এখন চোরাই ফোনের দখলে। এতে চলতি অর্থবছরে সরকার প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

এমআইওবির সভাপতি জাকারিয়া শাহিদ বলেন, দেশে মোবাইল ফোনের বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার। এ শিল্পে সরাসরি তিন থেকে চার লাখ মানুষ জড়িত। ২০১৮ সালের আগে বাংলাদেশে শতভাগ মোবাইল ফোন বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। কিন্তু সরকারি প্রণোদনায় ২০১৮ সাল থেকে দেশে একের পর এক মোবাইল কারখানা স্থাপিত হতে থাকে। এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ১৭টি মোবাইল ফোন কারখানা দেশে স্থাপিত হয়েছে।

তিনি বলেন, দেশের চাহিদার প্রায় ৯৯ শতাংশ ফোনই এখন দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু অবৈধভাবে ফোন আমদানি বন্ধ না করায় স্থানীয় বাজারের প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ এখন চোরাই ফোনের দখলে। তৈরি ফোন আমদানিতে যেখানে প্রায় ৫৮ শতাংশ কর রয়েছে, সেখানে এসব ফোন বিনা শুল্কে বাজারজাত হচ্ছে। ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে কারখানা স্থাপন করা ব্যবসায়ীরা।

তিনি আরও বলেন, ১৭টি কারখানায় বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এসব কারখানায় দক্ষ শ্রমিক ২৫ হাজারের বেশি। পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে আরও প্রায় ৫০ হাজার লোকের। সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠার। আরও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ মোবাইল ফোন রপ্তানির।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফোন প্রস্তুতকারকদের সংগঠন, মোবাইল ফোন অপারেটর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব অংশীজনের সঙ্গে কয়েক বছরের পর্যালোচনা শেষে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ২০২১ সালে এনইআইআর চালু করে। এ সিস্টেমের মাধ্যমে কার্যকরভাবে মোবাইল ফোনের অবৈধ আমদানি ও বিক্রয় রোধ করা সম্ভব। এনইআইআর সিস্টেম চালুর মাধ্যমে অবৈধভাবে ও কর ফাঁকি দিয়ে মোবাইল ফোনের আমদানি বন্ধ করা হবে, এ আশ্বাসের ভিত্তিতেই দেশের প্রধান প্রধান মোবাইল আমদানিকারকরা স্থানীয়ভাবে কারখানা স্থাপন করেছিলেন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিপুল সরকারি অর্থ ব্যয় করে এনইআইআর সিস্টেমটি কেনে এবং স্থাপন করে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে এনইআইআর চালুর কিছুদিনের মধ্যেই তা স্থগিত বা শিথিল করে দেওয়া হয়। কিন্তু এনইআইআর সিস্টেম শিথিল করে দেওয়ায় ফোন কারখানাগুলোর বিনিয়োগ এখন হুমকির মুখে। কারণ, অবৈধভাবে দেশে আসা হ্যান্ডসেটের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন, কারণ তারা কর ফাঁকি দেয়। বৈধ ফোন তৈরির কারখানাগুলোর জন্য রয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের নানা রকমের নিয়ম-নীতি, বিধি-নিষেধ, উচ্চ লাইসেন্স ফি। অথচ অবৈধ ফোনের ক্ষেত্রে কমিশনের কোনো নিয়ম-নীতিই প্রযোজ্য নয়।

তারা বলেন, এনইআইআর সিস্টেম শিথিল করার ফলে সরকার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। গ্রাহক নিম্নমানের হ্যান্ডসেট কিনে প্রতারিত হচ্ছেন, তা ছাড়া অবৈধ মোবাইলের কোনো ওয়ারেন্টি নেই। অবৈধভাবে আমদানি করা মোবাইল ফোন দিয়ে নানারকম অপরাধ সংগঠিত হয়, যা প্রতিরোধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়। এনইআইআর চালু করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো এসব অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করা।

এমআইওবির দাবি, এনইআইআর চালু করার কিছুদিন আগে থেকেই অবৈধ হ্যান্ডসেট আমদানিকারকরা সাবধান হয়ে যান। এতে চোরাই পথে মোবাইল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এনইআইআর বন্ধ করে দেওয়ার ফলে বৈধ মোবাইল হ্যান্ডসেটের বাজারে বড় ধস নেমে আসে। অবৈধভাবে এবং কর ফাঁকি দিয়ে দেশে আনা হ্যান্ডসেট ব্যবহারে কোনো বাধা না থাকায় অবৈধভাবে আমদানি বেড়েই চলেছে। বর্তমানে মোবাইল ফোনের বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ দখল করে আছে অবৈধভাবে আমদানি করা হ্যান্ডসেট। এসবের ওপর সরকার কোনো রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। বর্তমান অর্থবছরে সরকার এ খাত থেকে দুই হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য রাজস্ব হারাবে। বিষয়টি স্বীকার করে, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, অবৈধপথে দেশে ব্যাপকহারে মোবাইল ফোন ঢুকছে। ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে মোবাইল আনছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই তিনি অনিবন্ধিত মোবাইল ফোন বন্ধের ঘোষণা দেন।

গত ১৬ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে পলক জানান, জুলাইয়ের মধ্যেই অনিবন্ধিত মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে চোরাইপথে দেশে মোবাইল ফোন আনার পথ বন্ধ করতে হবে। প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণার পর ১৮ জানুয়ারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।

প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণা, বিটিআরসির তোড়জোড়ে জনমনে রীতিমতো ভীতির সঞ্চার করে। সবাই নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নিবন্ধিত নাকি অনিবন্ধিত তা জানতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। বিটিআরসির দেওয়া পদ্ধতিতে নিজের মোবাইল ফোনের বৈধতা যাচাইয়ে এসএমএস করে তথ্য জানার চেষ্টা করেন। অনেকে এসএমএস পাঠিয়ে ফিরতি এসএমএসে নিশ্চিত হন, আবার অনেকে ফিরতি এমএসএস পাননি। তবে বিটিআরসি ও প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণার তিন মাস পেরোলেও কাজ খুব একটা এগোয়নি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.