ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর প্রশাসনের শীর্ষ দুই কর্মকর্তা মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ প্রভাবশালী আমলারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের ফোন বন্ধ রয়েছে। দপ্তরের সঙ্গেও তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। অধস্তন কর্মকর্তাদের কোনো ধরনের নির্দেশনাও তারা দিচ্ছেন না। এ ছাড়া অন্যান্য দপ্তর প্রধানরাও অফিসে অনুপস্থিত। ফলে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে প্রশাসন। চেইন অব কমান্ড একেবারেই ভেঙে পড়েছে।
একাধিক কর্মকর্তা জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিশেষ করে সচিবরা মহা আতঙ্কে রয়েছেন। তারা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন। পদোন্নতি বঞ্চিতরা তাদের সামনে পেলে অপমান, অপদস্ত করবেন—এমন ভয়ও রয়েছে তাদের মধ্যে। তবে কয়েকজন সচিব গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে অফিস করেছেন। আবার দ্রুত তারা অফিস ত্যাগও করেন। হামলা হতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সচিবালয় ত্যাগ করেন। এ সময় তাদের হুড়োহুড়ি করতে দেখা যায়।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়া বলেন, এখন একটা বিশেষ পরিস্থিতি চলছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলেও হয়তো তারা অফিসে ফিরবেন। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের ফোন খোলা রয়েছে। সরকারি নম্বর ও তার ব্যক্তিগত নম্বর দুটিই সচল রয়েছে। তবে তিনি ফোন ধরছেন না। তার দপ্তরের কর্মচারী-কর্মকর্তারাও ফোন ধরছেন না। ফলে মাহবুব কোথায় আছেন তা স্পষ্ট নয়।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার ফোন নম্বর সচল পাওয়া গেছে। গত দুদিন তাকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তিনি আদৌ দেশে আছেন—নাকি বিদেশে পালিয়ে গেছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীও ফোন ধরছেন না। তিনি গতকাল অফিসও করেননি। অধীনস্ত কর্মকর্তাদের কোনো নির্দেশনাও তিনি দিচ্ছেন না বলে জানা গেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জানান, স্যার আজকে (গতকাল) অফিস করার কথা ছিল। তার বাসায় গানম্যান ও গাড়ি চালক গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আসেননি। স্যার কবে অফিসে আসবেন তাও আমরা জানি না। তিনি আসলে কোথায় আমরা জানি না।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনের খোঁজও মিলছে না। তিনি কোথায় আছেন তাও জানা সম্ভব হয়নি।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অজ্ঞাত স্থান থেকে তিনি গতকাল এক ভিডিও বার্তায় পুলিশের সব সদস্যকে ধৈর্যসহকারে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশ পুলিশের সব সদস্যকে দৃঢ় মনোবল নিয়ে ধৈর্যসহকারে নিজের নিরাপত্তা বজায় রেখে দায়িত্ব পালনের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। আশা করছি, সবার সহযোগিতায় দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের যেসব সদস্য জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আহত অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে যারা আছেন, তাদের সব ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, এখন যারা দেশের দায়িত্বে আছেন তাদেরই কর্মকর্তাদের আশস্ত করে অফিসে ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়বে। প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা অফিস ছেড়ে গা ঢাকা দিলে তা প্রশাসন ও দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। প্রয়োজনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সেনাবাহিনী তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অফিসে ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ সচিব ও অন্য কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব পালন করেন। কারা প্রশাসনে থাকবে, কারা থাকবে না সেটি পরবর্তী সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। সে পর্যন্ত কর্মকর্তাদের অবশ্যই অফিস করতে হবে। প্রশাসন সচল রাখতে হবে। এভাবে চলতে পারে না।