বহুকাল আগে, সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা এক দ্বীপ ছিল, নাম তার স্বর্ণলঙ্কা। দ্বীপের মাটি ছিল উর্বর, নদীতে রুপালি মাছের ঝাঁক আর গাছগুলো ফলে-ফুলে ভরা। কিন্তু দ্বীপের মানুষদের কপালে সুখ ছিল না। কারণ স্বর্ণলঙ্কার সিংহাসনে যে-ই বসত, সে-ই হয়ে উঠত এক ভয়ংকর দানব।
বহু বছর ধরে দ্বীপটি শাসন করত এক বৃদ্ধ ও শক্তিশালী দানব। তার দশটি মাথা ছিল, আর প্রতিটি মাথা থেকে বের হতো আগুন। সেই আগুনে দ্বীপের মানুষের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে যেত। দানব বলত, সে নাকি দ্বীপকে সোনায় মুড়ে দিচ্ছে। সত্যিই বড় বড় অট্টালিকা তৈরি হচ্ছিল, চকচকে রাস্তাঘাট বানানো হচ্ছিল। কিন্তু সেই উন্নয়নের আড়ালে সাধারণ মানুষ না খেয়ে মরছিল, তাদের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল, আর কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে দানবের অনুচরেরা গিলে ফেলত। দ্বীপের আদালত ছিল দানবের হাতের পুতুল, আর জ্ঞান বিতরণের মন্দিরগুলো পরিণত হয়েছিল দানবের স্তুতি গাওয়ার আখড়ায়।
মানুষের মনে ক্ষোভ জমতে জমতে একদিন তা আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল। দ্বীপের তরুণেরা, যাদের বুকে ছিল অসীম সাহস আর চোখে ছিল মুক্তির স্বপ্ন, তারা একত্রিত হলো। তাদের নেতা ছিল এক উজ্জল যুবক, নাম তার ‘মুক্তি’। মুক্তির ডাকে সাড়া দিয়ে দ্বীপের সমস্ত মানুষ একজোট হয়ে দানবের প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেল। তাদের সম্মিলিত গর্জনে দানবের সিংহাসন কেঁপে উঠল। অবশেষে, সেই বৃদ্ধ দানব তার অনুচরদের নিয়ে দ্বীপ ছেড়ে পালিয়ে গেল।
স্বর্ণলঙ্কায় সেদিন উৎসবের বন্যা বয়ে গেল। সবাই ‘মুক্তি’ আর তার তরুণ সঙ্গীদের মাথায় তুলে নাচতে লাগল। তারা ভাবল, এবার বুঝি দ্বীপের অভিশাপ কেটে গেছে। দানবের শাসন শেষ, এবার আসবে মানুষের দিন।
‘মুক্তি’ ও তার সঙ্গীরা সিংহাসনে বসল। তারা প্রতিজ্ঞা করল, এখন থেকে দ্বীপে সবাই সমান অধিকার পাবে। কেউ আর না খেয়ে থাকবে না, সবার বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে।
কিন্তু সিংহাসনটি ছিল জাদুকরী আর অভিশপ্ত। তাতে বসতেই ‘মুক্তি’র শরীরে এক অদ্ভুত পরিবর্তন শুরু হলো। ক্ষমতার স্বাদ, সোনাদানার ঝনঝনানি আর স্তাবকদের প্রশংসার স্রোতে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। যে হাত একদিন মানুষের জন্য লড়েছিল, সেই হাত এখন নিজের কোষাগার ভরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার সঙ্গীরা, যারা একদিন ন্যায়ের কথা বলত, তারাও দ্বীপের সম্পদ ভাগাভাগি করতে শুরু করল। পুরোনো দানবের অনুচরদের জায়গায় বসল নতুন অনুচরেরা, কিন্তু তাদের চরিত্র ছিল একই- দখল, লুট আর অত্যাচার।
দ্বীপের মানুষ অবাক হয়ে দেখল, তাদের নতুন রাজা ‘মুক্তি’র আচরণও ধীরে ধীরে পুরোনো দানবের মতোই হয়ে উঠছে। তার কথা বলার ধরণ, হাঁটার ভঙ্গি, এমনকি হাসিতেও ফুটে উঠছে সেই পুরোনো দানবের ছায়া। তারও যেন অদৃশ্য দশটি মাথা গজাতে শুরু করেছে, যা দিয়ে সে শুধু নিজের প্রশংসা শোনে আর সমালোচকদের দিকে আগুন ছুড়ে মারে।
যে মানুষগুলো একদিন মুক্তির আশায় বুক বেঁধেছিল, তাদের বুক ভেঙে গেল। তারা বুঝতে পারল, স্বর্ণলঙ্কার অভিশাপ আসলে কোনো দানবের নয়, অভিশাপটি ওই সিংহাসনের। যে-ই ওই সিংহাসনে বসে, সেই হয়ে যায় দানব।
আজও স্বর্ণলঙ্কার মানুষেরা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা আর কোনো ত্রাণকর্তার জন্য অপেক্ষা করে না। তারা বুঝতে পেরেছে, কোনো একজন ‘মুক্তি’ এসে তাদের উদ্ধার করবে না। যদি দ্বীপকে অভিশাপমুক্ত করতে হয়, তবে ওই অভিশপ্ত সিংহাসনটিকেই গুঁড়িয়ে দিতে হবে।