শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর ঢাকায় যা যা ঘটলো

পঞ্চাশোর্ধ আলিম মিয়া তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সামনে যখন সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন তখন ঘড়ির কাটায় বিকেল সাড়ে তিনটা। সিজদা থেকে উঠে দু’হাত তুলে অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন।শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে প্রাণহানির পর শেখ হাসিনার পদত্যাগে খুশির কান্না, বলছিলেন তিনি।

সোমবার দুপুরের পর থেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসতে শুরু করে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। তখন রাজধানীর ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থী, নারী-পুরুষসহ হাজারো সাধারণ মানুষ।

বিকেল তিনটার দিকে প্রথমে গণভবন পরে তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে পিজিআর, এসএসএফসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সরে গেলে সেখানে দলে দলে মানুষ প্রবেশ করে।

বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মিছিল নিয়ে উৎসব করতে দেখা যায় গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।

একইসাথে অনেককে এই দুটি স্থাপনা থেকে বিভিন্ন মালামাল নিয়ে যেতেও দেখা যায়।

এদিন বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ও স্থাপনায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ভাংচুর, আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটে।

বিকেলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সশস্ত্র বাহিনীর গাড়িতে রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনে যান বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধানসহ বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, শিগগিরই সংসদ ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা করা হবে।

এর কিছু পর জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করবে।

শেখ হাসিনার দেশত্যাগের বিষয়টি যেভাবে স্পষ্ট হয়-

সোমবার সকাল থেকে কঠোর কারফিউর মধ্যেও রাজধানীর পথে পথে নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। তাদের সাথে সাধারণ মানুষকেও যোগ দিতে দেখা যায়।

বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির দিন সকাল থেকেই রাস্তায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থান ছিল।

এরই মধ্যে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামলে বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাথে সংঘর্ষও হয়। সকাল থেকে বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের ইন্টারনেট সেবা।

দুপুর বারোটার দিক হঠাৎই দুপুরে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার ঘোষণা দেন সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান।

তার কিছুক্ষণ পর অনেক জায়গায় বিক্ষোভকারীদের ধৈর্য ধরার আহবান জানিয়ে মাঠে দায়িত্ব পালনরত সেনা কর্মকর্তারা জানান শিগগিরই তাদের জন্য সুখবর আসছে। ঢাকার রামপুরায় বিবিসি বাংলার প্রতিবেদক নিজেও এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন।

তখনই দেশের বিভিন্ন জায়গায় গুঞ্জন ছড়ায় সামরিক শাসন কিংবা জরুরি অবস্থার মতো বিষয়গুলো। এর মধ্যেই খবর আসে পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেছেন শেখ হাসিনা।

পরবর্তীতে সেনা দপ্তর থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় গণরোষের মুখে পদত্যাগ করেছে দেশ ছেড়ে গেছেন শেখ হাসিনা। সামরিক একটি হেলিকপ্টারে করে শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যরা ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয় বিবিসি।

যে চিত্র ছিল গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের-

শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবরটি যখন সারাদেশে ছড়িয়ে পরে, তখনও রাস্তায় ছিল লাখো মানুষ। মিছিল নিয়ে তাদের অনেকেই ছুটতে থাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সরকারি বাসভবন গণভবনের দিকে। নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে বেলা তিনটার দিকে গণভবনে ঢুকে পড়েন অনেকে।

অনেকেই গণভবনের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর করেছেন। চেয়ার-টেবিলসহ বেশকিছু জিনিসপত্র নিয়ে বের হতেও দেখা গেছে বেশ কয়েকজনকে। আবার অনেকের হাতে গণভবনের পুকুরের মাছ দেখা যায়। অনেককে সে সময় গণভবনের ভেতরেই বিজয় মিছিল করতে দেখা যায়।

বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে হঠাৎই তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পিজিআরসহ সব বাহিনী একে একে কার্যালয় ছাড়তে থাকে। সাধারণ মানুষের জন্য তারা এই কার্যালয়ের গেট পুরোপুরি খুলে দিলে ঢল নামে হাজারো মানুষের।

কার্যালয়ের ছাদে পতাকা তুলে বিজয় উল্লাস মত্ত হন অনেকে। সেখানে ছাত্র ছিল, শিশু, বৃদ্ধা কিংবা যুবক। এখানে এসে বিবিসি বাংলার কাছে অনেকে তাদের আক্ষেপের কথা বলেন। কেউ কেউ বলছিলেন, গত ১৫ বছরে মানুষ ভোট, মত প্রদানের অধিকারসহ বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক সাধারণ মানুষ মারা গেছেন। সে সব ক্ষোভের কথাও জানান অনেকে।

সেখানে পার্শ্ববর্তী নাখালপাড়া থেকে আসা একজন নারী বলেন “আমাদের সন্তানরা রাস্তায় রক্ত ঝরিয়েছে, সেই রক্তমাখা হাত নিয়ে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারে না”।

বঙ্গভবনে নতুন সরকার নিয়ে বৈঠক-

দুপুরেই ক্যান্টনমেন্টে যান বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। সেখানে সেনাপ্রধানের সাথে বৈঠকের পর বিকেলে সশস্ত্র বাহিনীর গাড়িতে করে তারা যান রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনে।

বৈঠক থেকে বেরিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে অতিদ্রুত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।

তিনি বলেন, “সিদ্ধান্ত হয়েছে, খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া হবে। সেই সাথে মুক্তি দেয়া হবে সেই সমস্ত ছাত্র নেতা-কর্মী, ছাত্রনেতাদের, যাতে অন্যায়ভাবে পহেলা জুলাই থেকে বন্দী করে রাখা হয়েছে, যাদের রাজনৈতিক কারণে বন্দী করে রাখা হয়েছে।”

ঠিক এর কিছুক্ষণ আগে তেজগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা বলেন, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করবেন এবং তাদের সমর্থিত বা প্রস্তাবিত ছাড়া কোন সরকার তারা সমর্থন করবেন না।

অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “সেনা সমর্থিত সরকার বা জরুরি অবস্থা দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত হতে পারে – এ ধরনের কোন সরকারকে বিপ্লবী ছাত্র জনতা গ্রহণ করবে না”।

শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি ভাঙচুর-

দুপুরের পর থেকেই রাজধানীর রাস্তায় নেমে আসে লাখো মানুষ। তাদের কেউ একাই এসেছেন। কেউ এসেছিলেন পুরো পরিবারসহ।

এসময় পথে পথে সশস্ত্র বাহিনীকে ঘিরে উল্লাস করতে দেখা যায় সাধারণ মানুষের অনেককেই।

বিক্ষুব্ধ জনতার একটি অংশ তখন অবস্থান নেয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় আর গণভবনের মাঝামাঝি বিজয় স্মরনি এলাকায়। সেখানে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল একটি প্রতিকৃতি ভেঙ্গে ফেলতে দেখা যায়।

রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় রং ছিটিয়ে, শ্লোগান দিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন।

ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় তখন অসংখ্য সাধারণ মানুষকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও দু:শাসনের অভিযোগ তুলে।

তাদের কেউ কেউ দেশে ফিরিয়ে এনে শেখ হাসিনার বিচারের দাবিও জানান।

আওয়ামী লীগ অফিস, থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় ভাংচুর-

দুপুরে পর থেকে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার ধানমন্ডি ও তেজগাঁও আওয়ামী লীগ অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় হামলা চালান বিক্ষুদ্ধরা।

এসময় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন আওয়ামী লীগের ওই দুই কার্যালয়সহ থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়গুলোতে।

রাজধানীতে এসময় হামলা ও ভাংচুর চালানো হয় পুলিশসহ দপ্তরসহ ভাটারা, আদাবর যাত্রাবাড়ি থানাসহ বেশ কিছু থানা ও সরকারি ভবনে।

হামলা ও ভাংচুর চালানো হয় বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তর টেলিভিশন, সময় টেলিভিশনে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন, এটিএন নিউজসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।

এসময় ইন্ডিপেন্ডেন্ট, একাত্তর ও সময় টেলিভিশনের সম্প্রচারও বন্ধ হয়ে গেছে বলেও জানানো হয়।

এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি, আওয়ামী লীগ অফিস, থানাসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাংচুরের খবর পাওয়া গেছে।

সারাদিনে বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ এবং হামলায় অন্তত ৪৪ জন নিহত হয়।

Comments (0)
Add Comment