রাষ্ট্রপতির ছবি সরানো নিয়ে রহস্য: দূতাবাসগুলোতে মৌখিক নির্দেশ, ছড়াচ্ছে গুঞ্জন

বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি সরানোর এক আকস্মিক ও অস্পষ্ট নির্দেশনা ঘিরে তৈরি হয়েছে ব্যাপক রহস্য ও গুঞ্জন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে লিখিত কোনো আদেশ ছাড়াই, কেবল মৌখিক নির্দেশে এই পদক্ষেপ নেওয়ায় সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির ভবিষ্যৎ নিয়ে পর্যন্ত জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যাখ্যা মেলেনি।

নির্দেশনার ধরণ ও বাস্তবায়ন

বিবিসি বাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোতে এই নির্দেশনা পৌঁছানোর ক্ষেত্রেও ছিল অসামঞ্জস্য।

  • লন্ডন: বাংলাদেশ হাইকমিশনকে ফোন করে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর নির্দেশ দেওয়া হলে শুক্রবার রাতেই তা কার্যকর করা হয়।

  • কলম্বো: শ্রীলঙ্কার দূতাবাসে শনিবার মৌখিকভাবে একই নির্দেশনা আসে। তবে সেখানকার এক কর্মকর্তা জানান, ৫ই আগস্টের পট পরিবর্তনের পরই তারা শেখ হাসিনা, শেখ মুজিবুর রহমান ও রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি সরিয়ে ফেলেছিলেন, তাই নতুন করে কিছু করার ছিল না।

  • তেহরান: ইরানের বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রপতির ছবির পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ছবিও টানানো ছিল। শনিবারের মৌখিক নির্দেশের পর দুটি ছবিই সরিয়ে ফেলা হয়।

তবে বেশ কয়েকটি দূতাবাস জানিয়েছে, তারা এমন কোনো নির্দেশনা পায়নি। এই অসামঞ্জস্যতা ও গোপনীয়তা বিতর্ককে আরও উস্কে দিয়েছে।

কেন এই নির্দেশনা? নেপথ্যে পরিবেশ উপদেষ্টার সফর?

হঠাৎ কেন এই পদক্ষেপ, তা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মুখ খুলতে নারাজ। তবে মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রের দাবি, সম্প্রতি পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সুইজারল্যান্ড সফরের সঙ্গে এর যোগসূত্র থাকতে পারে। জেনেভায় বাংলাদেশি দূতাবাসে রাষ্ট্রপতির ছবি দেখে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেন এবং বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানাবেন বলে উল্লেখ করেন।

যদিও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বিবিসি বাংলাকে এই দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, তিনি জেনেভা দূতাবাসে রাষ্ট্রপতির কোনো ছবি দেখেননি এবং এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তার কোনো কথাই হয়নি।

ছবি টাঙানোর নিয়ম কী বলে?

বাংলাদেশে সরকারি দপ্তরে ছবি প্রদর্শনের বিষয়টি মূলত আইন ও প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

  • আইনি বাধ্যবাধকতা: সংবিধানের ৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশের দূতাবাসগুলোতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি প্রদর্শন বাধ্যতামূলক।

  • প্রথা ও নির্দেশনা: রাষ্ট্রপতির ছবি ব্যবহারের কোনো সুনির্দিষ্ট আইন না থাকলেও, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বিভিন্ন দূতাবাসে তার ছবি রাখা একটি দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক প্রথা (Custom)। অন্যদিকে, ২০০২ সালের এক প্রজ্ঞাপনে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, যা ৫ই আগস্টের পর স্বাভাবিকভাবেই অকার্যকর হয়ে পড়ে।

সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদের মতে, “রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি থাকাটা একটা কাস্টম। এটা আইনি বা বেআইনি—কোনোটিই বলা যায় না। সরকার নির্দেশনা দিলে তা নামিয়ে ফেলতে হবে।”

সরকারের গোপনীয়তা ও রাজনৈতিক গুঞ্জন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতেই পারে, কিন্তু সেটি মৌখিক ও গোপনে হওয়া উচিত ছিল না। সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান এবং এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার উভয়েই মনে করেন, উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে একটি আনুষ্ঠানিক ও লিখিত নির্দেশনা জারি করা হলে এমন বিভ্রান্তি ও গুঞ্জন তৈরি হতো না।

সরকারের এই “লুকোচুরি” মনোভাবের কারণেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এই ঘটনা রাষ্ট্রপতির পদের ওপর কোনো সম্ভাব্য চাপের ইঙ্গিত কি না? যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু থেকেই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে আসছে, এই ধরনের অস্পষ্ট পদক্ষেপ সেই অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং জনমনে অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।

রাষ্ট্রপতির ছবি সরানো নিয়ে রহস্য: দূতাবাসগুলোতে মৌখিক নির্দেশ, ছড়াচ্ছে গুঞ্জন

 

Comments (0)
Add Comment