বিচারের ধীরগতিতে হতাশা, কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ এখনও স্বপ্ন

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হলেও আন্দোলনে জীবন দেওয়া শহীদদের পরিবারগুলোতে বিচার নিয়ে হতাশা এবং কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ না পাওয়ার আক্ষেপ স্পষ্ট। যে বৈষম্যহীন ও নিরাপদ দেশের জন্য তাদের সন্তানেরা প্রাণ দিয়েছিলেন, এক বছর পর সেই স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই কোটাবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ, যিনি এই আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে পরিচিত। তার আত্মত্যাগ আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ দিতে বড় ভূমিকা রাখে, যার ফলে ৫ আগস্ট তৎকালীন সরকারের পতন ঘটে।

সরকার এখন পর্যন্ত ৮৪৪ জন শহীদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করলেও তাদের পরিবারগুলোর বিচার প্রাপ্তির অপেক্ষা দীর্ঘ হচ্ছে।

বিচার নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ও হতাশা
শহীদদের পরিবারগুলোর অভিযোগ, হত্যাকাণ্ডের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বিচার প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

আবু সাঈদের ভাই আবু হোসেন বলেন, “আমার ভাই জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম ও আইকনিক শহীদ। দিনের আলোতে তাকে হত্যার বিচার দ্রুত হবে বলে সবাই আশা করেছিল। কিন্তু তদন্ত করতেই এক বছর চলে গেল। আমরা এখনো ড. ইউনূসের শাসনামলে বিচার সম্পন্ন হওয়ার আশায় আছি।”

আন্দোলনের প্রথম নারী শহীদ, উত্তরার নাঈমা সুলতানার মা আইনুন নাহার বলেন, “নাঈমাকে স্নাইপার দিয়ে হত্যার ভিডিও থাকার পরও এক বছরে বিচারের কোনো অগ্রগতি দেখিনি। ড. ইউনূস কথা দিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। আমরা চাই এই হত্যার বিচার হোক, যাতে ভবিষ্যতে কোনো সরকার এভাবে শিক্ষার্থীদের হত্যা করতে সাহস না পায়।” তিনি সরকারের দেওয়া আর্থিক সহায়তার দীর্ঘসূত্রিতা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেন।

মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত রিতা আক্তারের মা রেহানা বিবি বলেন, “এখন পর্যন্ত কোনো বিচার পাইনি। আমরা শুধু বিচারের আশায় পথ চেয়ে বসে আছি।”

একইভাবে, ফার্মগেটে নিহত ছাত্র গোলাম নাফিজের বাবা গোলাম রহমান এবং হবিগঞ্জে নিহত সাংবাদিক সোহেল আখুঞ্জির স্ত্রী মৌসুমী আক্তারও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ কতদূর?
শুধু বিচার নয়, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও হতাশ শহীদদের পরিবারগুলো।

আবু সাঈদের ভাই আবু হোসেনের মতে, “যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমার ভাই জীবন দিয়েছিলেন, সেই বৈষম্যমুক্ত
বাংলাদেশের পরিপূর্ণ রূপ আমরা পাইনি। এখনও চাঁদাবাজি আর হত্যাকাণ্ড চলছে।”

নাঈমার মা আইনুন নাহার বলেন, “চারপাশে যা দেখছি, তাতে পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছে না। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। এই হত্যাগুলোর বিচার হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো।”

শহীদ রিতার মা, নাফিজের বাবা এবং সোহেলের স্ত্রীর কণ্ঠেও একই সুর। তারা বলছেন, নিরাপত্তাহীনতা, ভয় আর অপরাধ প্রবণতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যার জন্য তাদের সন্তানেরা জীবন দেয়নি। শনির আখড়ায় নিহত ইউসুফ সানোয়ারের বোন বিউটি বেগম বলেন, “এক বছর পর এসে মনে হচ্ছে, সবাই স্বার্থপর হয়ে গেছে। আগে যারা পাশে ছিলেন, এখন তারা কথাও বলেন না। এমন দেশের জন্য তো আমার ভাই জীবন দেয়নি।”

সব মিলিয়ে, জুলাই শহীদদের পরিবারগুলো বিচারের আশায় পথ চেয়ে থাকার পাশাপাশি একটি নিরাপদ ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে, যা এখনও অধরা রয়ে গেছে।

Comments (0)
Add Comment