গাজীপুরের শ্রীপুরের বহুল আলোচিত র্যাব পরিচয়ে শ্রমিকদের বেতন ও বোনাসের ১৯ লক্ষাধিক টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় মূলহোতা হামিম ইসলামসহ ৫ জন ডাকাত সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বুধবার রাতে রাজধানীর রামপুরা ও উত্তরা এবং গাজীপুরের টংগী থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় ডাকাতিতে ব্যবহৃত মাইক্রোবাস, র্যাব জ্যাকেট, হ্যান্ডকাফ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদিসহ ছিনতাইকৃত অর্থ উদ্ধার করে র্যাব। বৃহস্পতিবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়।
গ্রেফতার কৃতরা হলো- ভোলার লালমোহন থানার শাহজাহান বারির ছেলে হামিম ইসলাম (৪৫), গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থানার মৃত আলী আকবরের ছেলে জিন্নাহ মিয়া (২৭), গাজীপুরের টঙ্গী থানার হাতেম আলীর ছেলে মোঃ আমিন হোসেন (৩০), দিনাজপুরের কাহারোল থানার ইউসুল আলীর ছেলে মোঃ রুবেল ইসলাম (৩৩) ও গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার সিরাজুল ইসলামের ছেলে মোঃ আশিকুর রহমান (৪২)।
জানা যায়, গত ৬ জুন ২০২৪ বিকালে গাজীপুরের শ্রীপুরের সেলভো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কারখানার ৩ নম্বর গেটের সামনে গ্রেফতারকৃতরা র্যাব পরিচয়ে কারখানার ৩৩ জন কর্মকর্তাকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ ও জিম্মি করে। পরে তাদের কাছে থাকা শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও ট্রাক ভাড়ার ১৯ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা ছিনতাই করে। এ ঘটনায় কারখানা কর্তৃকপক্ষ বাদী হয়ে ওই দিনই গাজীপুরের শ্রীপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করে।
এদিকে ঘটনাটি বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হলে দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১ এর একটি দল রাজধানীর রামপুরা ও উত্তরা এবং গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে গাজীপুরের শ্রীপুরে অভিযান চালিয়ে জড়িতদের গ্রেফতার করে।
এ সময় ডাকাতিতে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস, ২টি খেলনা পিস্তল, ২টি র্যাব জ্যাকেট, ২টি র্যাবের ক্যাপ, ১টি হ্যান্ডকাফ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি এবং ছিনতাইকৃত ১৬,১৯৭০ টাকা উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা উক্ত ঘটনার সাথে তাদের সম্পৃক্ততা বিষয়ে তথ্য দিয়েছে বলে র্যাবের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র এবং প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতদের র্যাবকে জানানো তথ্যানুযায়ী , গত ৬ জুন ২০২৪ তারিখ বিকালে গাজীপুরের। শ্রীপুরের সেলভো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর ৩ জন কর্মকর্তা একটি প্রাইভেট ব্যাংক থেকে কারখানার শ্রমিকদের বেতন, ঈদ বোনাস ও পরিবহন খরচ দেওয়ার জন্য ১৯ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা উত্তোলন করে প্রাইভেটকারযোগে কারখানায় যাচ্ছিল। পরবর্তীতে প্রাইভেটকারটি কারখানার ৩ নম্বর গেটের সামনে পৌছালে গ্রেফতারকৃতরা একটি টয়োটা এক্স নোয়া গাড়ি নিয়ে প্রাইভেটকারটির গতিরোধ করে। এ সময় গ্রেফতারকৃতরা র্যাবের জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় নিজেদের ভুয়া র্যাব পরিচয় দিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে কারখানার কর্মকর্তাদের জোরপূর্বক অপহরণ করে গ্রেফতারকৃতদের গাড়িতে (টয়োটা এক্স নোয়া) তুলে নিয়ে মারধর করে এবং গাজীপুর-ময়মনসিংহ সড়কের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। পরবর্তীতে সন্ধ্যা আনুমানিত ৬টার সময় শ্রমিকদের বেতন-বোনাসের টাকা রেখে কারখানার কর্মকর্তাদের ঢাকা-ময়মনসিংহ সহাসড়কের গাজীপুরের হোতাপাড়া এলাকায়া নামিয়ে দিয়ে গ্রেফতারকৃতরা দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে আত্মগোপনে চলে যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা র্যাবকে জানায়, তারা একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত দল। গ্রেফতারকৃত হামিম এই ডাকাত চত্রের প্রধান। এই ঢাকার চক্রে ১০-১২ জল সমস্য রয়েছে। এছাড়াও গ্রেফতারকৃতরা ডাকাতি কাজে মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন যানবাহন ব্যবহার করতো বলে জানা যায়। গ্রেফতারকৃতরা গত ৩-৪ বছর যাবৎ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সদস্য পরিচয় দিয়ে গাজীপুর, টঙ্গী, উত্তবাসহ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতির কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। মেফতারকৃতরা ডাকাতির কৌশল বিভিন্না সময় নিজেদেরকে র্যাব, পুলিশ, ডিবি, সাংবাদিক ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সদস্য পরিচয় প্রদানসহ ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত গাড়িতে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন বাহিনীর লোগো সম্বলিত স্টিকার ব্যবহার করতো বলে জানায়।
জানা গেছে, চক্রটি বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার সদস্য পরিচয়ে চক্রের কিছু সদস্য ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করে আর্থিক লেনদেন পর্যবেক্ষণ করতো। পরবর্তীতে বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলনকারী ব্যক্তিকে টার্গেট করে বাহিরে অবস্থানকৃত চক্রের অন্য সদস্যদেরকে বিষয়টি অবগত করতো। এসময় বাহিরে অবস্থানকৃত চক্রের সদস্যরা তাদের ব্যবহৃত গাড়ি দিয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তির গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকে। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃতরা সুবিধাজনক নির্জন স্থানে টার্গেটকৃত ব্যক্তির গাড়ির গতিরোধ করে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জ্যাকেট পরিধান করে নিজেদেরকে বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে ভিকটিমকে অপহরণ করে জোরপূর্বক গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে ভিকটিমকে মারধর করে তার কাছে থাকা টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে নির্জন স্থানে তাকে ফেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। গ্রেফতারকৃতরা প্রতি মাসে ২-৩টি ডাকাতি করতো বলে জানায় এবং ডাকাতিকৃত টাকা চক্রের সদস্যদের মাঝে নিজেরা ভাগাভাগি করে নিত।
র্যাব সূত্রে জানা যায়, গ্রেফতারকৃত হামিম বিগত ৩-৪ বছর পূর্বে ডাকাতি পেশায় জড়িয়ে পরে। পরবর্তীতে সে ডাকাতি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ১০-১২ জনের একটি ডাকাত চক্র গড়ে তোলে। তার নির্দেশনায় চক্রের অন্যান্য সদস্যরা ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এলাকায় ডাকাতির টার্গেট নির্ধারণ করে তাকে তথ্য প্রদান করতো। পরবর্তীতে তার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের। নিকট হতে সুবিধাজনক স্থানে অর্থ ছিনতাই করতো। তার নেতৃত্বে এই চক্রটি ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে বেশকিছু ডাকাতি সংঘটিত করেছে। এছাড়াও সে ইতিপূর্বে একটি মামলায় কারাভোগের সময় সেখানে থাকা দেশের বিভিন্ন এলাকার দুর্ধষ ডাকাতদের তার চক্রে অন্তর্ভুক্ত করে। এছাড়াও সে পবিত্র ঈদ-উল-আযহাকে সামনে রেখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভুয়া পরিচয় দিয়ে কয়েকটি সম্ভাব্য স্থানে ডাকাতির পরিকল্পনা করছিল।
অপরদিকে গ্রেফতারকৃত দলের সদস্য রুবেল দীর্ঘ দিন যাবৎ ডাকাতি পেশার সাথে জড়িত। সে এই ডাকাত চক্রের মূলহোতা গ্রেফতাকৃত হামিমের প্রধান সহযোগী। সে ডাকাতির কৌশল হিসেবে বিভিন্ন সময় নিজেকে ভুয়া সাংবাদিক ও মাঝে মাঝে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভুয়া সদস্য হিসেবে পরিচয় প্রদান করতো বলে জানা যায়। সে ইতিপূর্বে বরিশাল, ফরিদপুর, গাজীপুর, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভুয়া ডিবি ও র্যাব পরিচয়ে বেশকিছু ডাকাতি সংঘটিত করেছে। সে বর্ণিত ঘটনার দিন ভিকটিমদের ব্যাংক থেকে বের হওয়ার তথ্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত হামিমকে জানায়। সে ইতিপূর্বে ভুয়া ডিবি পরিচয়ে ডাকাতি মামলায় গ্রেফতার হয়ে ০২ বছর কারাভোগসহ অন্যান্য মামলায় বেশকয়েকবার কারাভোগ করেছে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ধর্ষণ, মাদক ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মিথ্যা পরিচয়ে ডাকাতি সংক্রান্ত একাধিক মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত জিন্নাহ এবং গ্রেফতারকৃত আমিন এই ডাকাত চক্রের অন্যতম সদস্য। তারা ডাকতির সময় টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে গাড়িতে উঠাতো। গ্রেফতারকৃত জিন্নাহ এর বিরুদ্ধে গাজীপুরের জয়দেবপুর থানায় ভুয়া ডিবি পরিচয়ে ডাকাতি সংক্রান্ত মামলা রয়েছে এবং উক্ত মামলায় প্রায় ৩২ বছর করাভোগ করেছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত আশিক এই ডাকাত চক্রের নবীন সদস্য। সে ডাকাতির পূর্বে টার্গেটকৃত স্থানে গাড়ি চালিয়ে রেকি করতো এবং ডাকাতি সংঘটনের পর সম্ভাব্য কোন কোন রাস্তা দিয়ে পলায়ন করা সুবিধাজনক হবে তা নির্ধারণ করে গ্রেফতারকৃত হামিমকে জানাতো। সে ইতিপূর্বে গাড়ি চালনোর পাশাপাশি রাজধানীর আশেপাশে বিভিন্ন সময় তার যাত্রীদের নিকট হতে ছিনতাই করতো বলে জানা যায়। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত জিন্নাহর মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত হামিম এর সাথে পরিচিত হয়ে এই ডাকাত চক্রের সাথে জড়িত হয়। মূলত সে গাড়ি চালনায় পারদর্শী এবং রাজধানী ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার আঞ্চলিক রাস্তাযাটিসমূহ পরিচিত হওয়ায় তাকে গ্রেফতারকৃত হামিম তার ডাকাত চক্রে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।