সুন্দরবনে কেন বারবার আগুন?

দেশের ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের তিন বর্গকিলোমিটার এলাকার গাছপালা আগুনে পুড়ে গেছে। রোববার (৫ মে) প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন আর না ছড়ালেও আগুন জ্বলছে। আর এই আগুন নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।

ওই এলাকার পরিবেশ কর্মীরা জানিয়েছেন, সুন্দরবনে ২৪ বছরে ২৬ বার আগুন লেগেছে। প্রায় প্রতি বছরই আগুন লাগে। এর পেছনে নানা স্বার্থান্বেষী মহলের হাত থাকতে পারে।

সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির কাছের গভীর বনে শনিবার দুপুর ১২টার দিকে ওই আগুন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নজরে আসে। ফায়ার সার্ভিস একদিন পর রোববার ভোর ৬টার দিকে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। রোববার বিকেল ৫টায় তারা আগুন নেভানো কাজ স্থগিত করে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের খুলনা বিভাগের উপপরিচালক মামুন মাহমুদ। তিনি বলেন, আগুন এখনো নিয়ন্ত্রণে এসেছে তা বলতে পারব না। তবে আমরা বিকেলে আগুন নেভানোর কাজ স্থগিত করেছি। আগামীকাল (সোমবার) আবার কাজ শুরু কবর।’

তিনি জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস ছাড়াও নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, ভলান্টিয়ার ও স্থানীয় লোকজন কাজ করছে। আগুনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা বুশ ফায়ার। ঝোঁপঝাড়ে কোনো কারণে আগুন লেগেছে। সেখান থেকেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।’

সুন্দরবনের ওই এলাকাটি বাগেরহাট জেলার মেড়েলগঞ্জ উপজেলার নিশানবাড়ি ইউনিয়ন এলাকায়। ওই ইউনিয়নের আট নাম্বার ওয়ার্ডের সদস্য আবু তাহের বলেন, ‘আমরা শনিবার বেলা সাড়ে ১১টা-১২টার দিকে আগুনের খবর পাই। এরপর আমরা সাধারণ মানুষ ও বনবিভাগের স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করি। আমরা বিকেল ৪টা পর্যন্ত নিজেরাই আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি। ফায়ার সার্ভিস আসে আজকে (রোববার) ভোরে।’

তিনি জানান, এখন চারপাশে ঘেরাও দিয়ে, আশপাশের গাছপালা কেটে আগুন যাতে না ছড়াতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

তার কথায়, ‘এটা গভীর বন। এখান থেকে দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে পানি আছে। আর খাল শুকিয়ে গেছে। এই বনে বাঘ, হরিণ, বানর, সজারু ও শূকরের মতো বন্য প্রাণীদের বসবাস। গত বছর বনের এই এলাকায় বাঘের আক্রমণে একজন নিহত ও একজন আহত হন। এখানে সুন্দরি, গরান, গেওয়া, পশুর, ছৈলাসহ নানা ধরনের গাছ আছে। সেগুলো পুড়ে গেছে। তার কথায়, ‘বনে এখনো আগুন জ্বলছে। এই আগুনের কারণে অনেক বন্যপ্রাণী লোকালয়ে চলে আসতে পারে।’

এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক মো. নুরুল আলম শেখ সুন্দরবনের যে এলাকায় আগুন লেগেছে সেই এলাকা রোববার পরিদর্শন করেছেন। তার বাড়ি বাগেরহাট। তিনি জানান, ‘ওটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল হলেও ওই এলাকায় চোরা শিকারি, কাঠ পাচারকারীসহ সাধারণ মানুষের অবাধ আনাগোনা। আমার কাছে কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল মনে হয়নি। রোববার দুপুরে ফায়ার সার্ভিস খবর পেলেও আগুন আরও দুই দিন আগে লেগেছে বলে স্থানীয়রা আমাকে জানিয়েছে। তারপরও ফায়ার সার্ভিস আজ (রোববার) সকালে গিয়েছে।’

তার অভিযোগ, ‘এই আগুনের পেছনে যারা মাছ ধরেন তাদের হাত থাকতে পারে। এর আগেও ওই বনে আগুন লেগেছে। আগুনে গাছ পুড়ে গেলে মাছের জাল পাততে সুবিধা। আবার পোড়া কাঠের গন্ধে খালে অনেক মাছ আসে। কাছেই লতিফের ছিলায় মাছ ধরেন স্থানীয়রা। তাদেরও হাত থাকতে পারে। যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে বাঘের কবলে পড়ে গত বছর একজন চোরা শিকারি মারা যান। বনে আগুন লাগার কারণ হলো ওইসব চোরাশিকারি, মৎস্যজীবী ও মৌয়ালদের নিয়ন্ত্রণ না করা। তারা বনে রান্নাবান্না করে। ধুমপান করে সেখান থেকেও আগুল লাগে। আসলে বনে কোনো নিয়ন্দ্রণ নাই। এক শ্রেণির বনকর্মকর্তা তাদের স্বার্থে বনকে লোকালয়ে পরিণত করেছেন।’

তিনি জানান, ‘গত ২৪ বছরে সুন্দরবনে ২৬ বার আগুন লেগেছে। আমি মনে করি অধিকাংশ আগুনই মানবসৃষ্ট। এর পেছনে স্বার্থান্বেষী মহলের হাত আছে। এর ফলে সুন্দরবনের প্রাণ বৈচিত্র্য হুমকির মুখে।’

রোববার প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীসহ বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসনের লোকজন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম বলেন, ‘আগুনের ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণের জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।’

তার কথায়, ‘আগুন লাগার পর বনরক্ষী, স্বেচ্ছাসেবক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই মিলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছে।’

প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী সুন্দরবন থেকে জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। তারপরও আমরা আরও তিন-চার দিন পর্যবেক্ষণে রাখব। আগুনে কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এখনো ঠিক বলা যাবে না। ক্ষয়ক্ষতি কী পরিমাণে হয়ে তা নির্ধারণের জন্য আরও একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করব। আমরা এখানে জীববৈচিত্র্যের কী ক্ষতি হলো তাও দেখব।’

তিনি বলেন, ‘নিচের ঝোঁপঝাড়, হিউমাস পুড়ে গেছে। গাছের পাতা পুড়ে গেলেও গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে।’

চোরাশিকারি, মৎস্যজীবী, বা কাঠ পাচারকারীদের অবাধ আনাগোনার কারণে এই ধরনে আগুন লাগতে পারে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটি বিষয় হলো, যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে প্রকৃতিগত পরিবর্তন হয়েছে। সেখানে এখন আর জোয়ারের পানি ওঠে না। ইকোলজিক্যাল পরিবর্তন হয়েছে। হিউমাস জমেছে। মিথেন গ্যাস থেকে আগুন হতে পারে। আবার কেউ কোনো দাহ্য পদার্থ ফেলার কারণেও হতে পারে।’

এর আগেও সুন্দরবনে আগুন লাগার ব্যাপারে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের খুলনা বিভাগের উপ পরিচালক মামুন মাহমুদ বলেন, ‘সে ব্যাপারে আমার জানা নাই।’

বিশ্বের সবচয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরনের আয়তন এখন ১০ হাজার বর্গকিলেমিটারের এসে ঠেকেছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে বলেছে, ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ৪৫৩ বর্গকিলোমিটার কমেছে। -ডয়চে ভেলে

Comments (0)
Add Comment