বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে ধূমপান করা নিয়ে দুই তরুণীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই, এবং প্রতিবাদও হয়েছে। তবে এই ঘটনাকে ঘিরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যে ক্ষোভ এবং সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিশেষ করে, মেয়েদের ধূমপান করা কি বেআইনি? এমন প্রশ্নের মাঝে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী তাঁর মন্তব্যে বলেন, “ওপেন (উন্মুক্ত) জায়গায় সিগারেট খাওয়া নারী-পুরুষ সবার জন্য নিষেধ।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই বক্তব্যের পর অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি কি দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা মব অপরাধকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন? এ ধরনের মন্তব্যে মানুষের ক্ষোভ আরও বেড়ে গেছে।
ঘটনাস্থলে ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে একদল বিক্ষোভকারী আজ সোমবার বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। সামাজিক মাধ্যমে এই মন্তব্যের ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে, এবং অনেকেই বলছেন, এটি ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের একটি উদাহরণ।
ঘটনা কী?
এটি ঘটেছে শনিবার সন্ধ্যায় লালমাটিয়া আড়ংয়ের পাশের গলিতে, যেখানে দুই তরুণী চায়ের দোকানে বসে চা পান এবং ধূমপান করছিলেন। তখন এক ব্যক্তি তাদের ধূমপান নিয়ে আপত্তি জানান এবং দোকান বন্ধ করতে বলেন। এরপর দুই তরুণীর সঙ্গে ওই ব্যক্তির কথা কাটাকাটি হয় এবং এক পর্যায়ে একজন তরুণী ওই ব্যক্তির গায়ে চা ছুঁড়ে দেন। তরুণীরা জানিয়েছেন, ওই ব্যক্তি তাদের অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়েছিলেন, যার কারণে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে চা ছুঁড়েছেন।
এরপর ওই ব্যক্তি আরও লোকজন নিয়ে সেখানে এসে তরুণীদের ঘিরে ফেলেন এবং তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। ঘটনাটি পুলিশকে জানানো হলে তারা এসে দুই তরুণীকে উদ্ধার করে মোহাম্মদপুর থানায় নিয়ে যায়।
এক তরুণী ফেসবুকে পুরো ঘটনাটি বর্ণনা করে পোস্ট করেন, তবে পরে তিনি তার অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট করে ফেলেন। তিনি পোস্টে দাবি করেন যে, মব তাদের গেইটে আটকে ফেলে এবং শারীরিক আঘাত করেছে।
পুলিশের ভূমিকা
এদিকে, পুলিশ জানায় যে, ঘটনার পর উভয় পক্ষের মধ্যে আপস মীমাংসা হয়েছে এবং কোনো পক্ষই পরে অভিযোগ করেনি। তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এই ঘটনাকে ভিক্টিম ব্লেমিং এবং আইনের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আইন অনুযায়ী এটি স্পষ্টতই অপরাধ, এবং পুলিশের উচিত ছিল হামলাকারীদের গ্রেফতার করা।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যে সমালোচনা
এই ঘটনাকে ঘিরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যে আরও ক্ষোভ বাড়ে। তিনি জানান, “ওপেন জায়গায় সিগারেট খাওয়া নারী-পুরুষ সবার জন্য নিষেধ,” কিন্তু এতে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা ছিল অনেকের কাছে বিভ্রান্তিকর। অনেকেই তাঁর মন্তব্যকে অবাস্তব এবং অযৌক্তিক বলে সমালোচনা করেছেন। এমনকি, অনেকেই তাঁর এই মন্তব্যকে নারীর ওপর সহিংসতার প্রতি উদাসীনতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে দেখছেন।
আইনগত অবস্থান
বাংলাদেশে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, পাবলিক স্পেসে ধূমপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, শপিংমল, হাসপাতাল, ট্রান্সপোর্ট স্টেশন, বিমানবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন এবং অন্যান্য পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ। কিন্তু ঢাকার অনেক অলিগলি এবং ফুটপাতে অবৈধভাবে টং দোকানগুলো গড়ে উঠেছে, যেখানে চা, সিগারেটসহ অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি ধূমপান করা হয়। এগুলো সরকারি বা আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কখনোই পাবলিক স্পেস হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি।
বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ
সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এসেছে এবং বিক্ষোভকারীরা দাবি করেছেন, মব অপরাধের শিকার নারীদের প্রতি সহানুভূতি জানানো উচিত, এবং তাদের অধিকার সুরক্ষিত করা উচিত। অনেকে বলছেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এ ধরনের মন্তব্য নারীর নিরাপত্তা ও অধিকারের প্রতি একধরনের অবজ্ঞা।
আইন ও নিয়ম
পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ হলেও, সিগারেট খাওয়ার স্থান নিয়ে আইন বিশেষভাবে কিছু নির্দিষ্ট করেছে। এটি শুধুমাত্র সরকার বা স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্তে নির্ধারিত পাবলিক স্পেসে প্রযোজ্য হবে, যা সবার কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত।
এ ঘটনার পেছনে যে আইনগত দৃষ্টিকোণ রয়েছে, তার ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে আইনজীবীরা এবং মানবাধিকার কর্মীরা সবাই একমত হয়েছেন যে, কেবলমাত্র সিগারেট খাওয়া নয়, এর সাথে যুক্ত সহিংসতা ও অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার অগ্রহণযোগ্য।
এই ঘটনার পর মানুষের মধ্যে আরও তীব্র প্রতিবাদ দেখা দিয়েছে এবং মেয়েদের ওপর সহিংসতা রোধে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি উঠেছে।