ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে বিভিন্ন ব্যাচ থেকে ক্যাডার (প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা) হওয়া অনেকের নাম বের হয়ে আসছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অভিযানে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের গ্রেপ্তার সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে এসব নাম পাওয়া যাচ্ছে। আপাতত ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার হওয়াদের নামের তালিকা তৈরি ও জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে বিষয়টি।
এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাইছেন না তদন্তসংশ্লিষ্টরা। তবে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) অধীনে নেওয়া বিসিএস পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যারা ক্যাডার হয়েছেন, তাদের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। কাউকে কাউকে রাখা হয়েছে নজরদারিতেও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিমেল চাকমা বলেন, ‘এখনই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার কয়েকটি ব্যাচের এমন অনেকে আছেন, যারা এই চক্রের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর পেয়ে ক্যাডার হয়েছেন। চক্রটির গ্রেপ্তার হওয়া সদস্যদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
বিসিএস প্রিলিমিনারি, লিখিতসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০টি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যুক্ত এই চক্র। খোদ পিএসসির একাধিক কর্মকর্তা এসব প্রশ্ন ফাঁস করে আসছেন দীর্ঘ সময় ধরে। গত ৬ থেকে ৮ জুলাই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রে জড়িত সন্দেহে ১৭ জনকে আটক করে সিআইডি। আটকের পর গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টন থানায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে মামলা করা হয় সিআইডির পক্ষ থেকে। এতে ৩১ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয়সহ ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতে তোলা হয় গতকাল। যাদের ১০ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন সাতজন। পলাতক আছেন ১৪ জন আসামি। ফ্রিজ (অবরুদ্ধ) করা হয়েছে গ্রেপ্তার ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব।
প্রশ্ন ফাঁস করে দেন উপপরিচালক মো. আবু জাফর: গত ৫ জুলাই রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষা ঘিরে তৎপর হয় প্রশ্ন ফাঁস চক্রটি। এই চক্রের অন্যতম সদস্য পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম ও ডেসপাস রাইটার খলিলুর রহমান। পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফরের মাধ্যমে দুই কোটি টাকার বিনিময়ে রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের চুক্তি করেন তারা। চুক্তি অনুযায়ী প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। সাজেদুল ও খলিলুর হোয়াটসঅ্যাপে সেই প্রশ্ন চক্রের সংশ্লিষ্ট অন্য সদস্যদের দেন। গত ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস করেন তারা। আর ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তরপত্র দিয়ে প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেন। খলিলকে চাকরিপ্রার্থী এনে দিতেন পিএসসির সহকারী পরিচালক এসএম আলমগীর। পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফরের মাধ্যমে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন সংগ্রহ করতেন অফিস সহায়ক সাজেদুল। গ্রেপ্তার সাজেদুল ও খলিল পুলিশের কাছে প্রাথমিকভাবে এসব স্বীকার করেছেন।
পরীক্ষার দুদিন আগে হোটেলে রাখা হতো পরীক্ষার্থীদের: সাজেদুল তার সহযোগী সাখাওয়াত ও সাইমের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ভাড়া বাসা বা হোটেলে জড়ো করতেন। নিয়োগ পরীক্ষার দু-এক দিন আগেই সেসব জায়গায় পরীক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতেন হুবহু প্রশ্ন। গত ৫ মে পিএসসির আয়োজনে রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে (নন-ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষার জন্য গ্রেপ্তার নিয়ামুল পল্টন এবং খিলগাঁও এলাকায় বাসাভাড়া নিয়ে এভাবেই চাকরিপ্রার্থীদের প্রশ্নপত্র দিয়ে সেগুলোর সমাধান করিয়েছেন। সাজেদুলকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাজেদুল তার সহযোগীদের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীদের সংগ্রহ করার পাশাপাশি নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে এই চক্রের অন্যতম সদস্য পিএসসির সাবেক আলোচিত-সমালোচিত গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর কাছে একই পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তরপত্র দিয়েছেন। এ ছাড়া এই চক্রে সরাসরি জড়িত আছেন গ্রেপ্তার হওয়া পিএসসির আরেক উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর সেনানিবাসের প্রতিরক্ষা ও অর্থ বিভাগের অডিটর প্রিয়নাথ রায় এবং ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক মো. মামুনুর রশিদ। এ ছাড়া জড়িত আছেন পিএসসির পলাতক সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়। প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত বর্তমান পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গতকাল সাময়িক বরখাস্ত করেছে পিএসসি।
১৪ আসামি পলাতক, ফোন ট্র্যাকিংয়েও হদিস মিলছে না: প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ১৪ জন পলাতক আছেন। তাদের ধরতে তৎপরতা চালাচ্ছে সিআইডি। তাদের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করেও হদিস মিলছে না। পলাতক আসামিরা হলেন নিখিল চন্দ্র রায়, মো. শরীফুল ইসলাম ভূঁইয়া, দীপক বণিক, মো. খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, এ কে এম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, মো. গোলাম হামিদুর রহমান, মুহা. মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ।
পলাতকদের ব্যাপারে সিআইডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় অনেক সন্দেহভাজন গা-ঢাকা দিয়েছেন। মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করেও তাদের অবস্থানের খোঁজ মিলছে না।’
আলোচনায় ড্রাইভার আবেদ: প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তারদের একজন আবেদ আলী। একসময় পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ছিলেন। সেই সময় থেকেই জড়িয়ে পড়েন প্রশ্ন ফাঁসে। এ ঘটনায় তিনি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন আদালতে। পিএসসির চাকরি থেকে অবসরের পর এলাকায় গিয়ে উপজেলা নির্বাচনে লড়ার জন্য প্রচারণা চালান আবেদ আলী। তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ঢাকায় দুটি বহুতল ভবন এবং মাদারীপুরে একটি বিলাসবহুল বাড়ি। গত ১৮ মে আবেদ আলী তার ফেসবুক আইডিতে একটি স্ট্যাটাস দেন। যাতে তিনি লেখেন, ‘আমাদের নতুন হোটেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম আজ। হোটেল সান মেরিনা, কুয়াকাটা’। একই সঙ্গে আলোচনায় রয়েছেন তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। পড়তেন সুপরিচিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক সম্পাদক। প্রশ্ন ফাঁসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সিয়ামকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ : প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পিএসসির তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের মধ্যে পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীও রয়েছেন। গতকাল তাদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। বিএফআইইউ জানায়, ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা-সংক্রান্ত চিঠি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো হয়েছে। এ-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ থাকবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যাদের হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়, তারা হলেন পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান ও ডেসপাস রাইটার সাজেদুল ইসলাম। এ ছাড়া তালিকায় রয়েছেন নোমান সিদ্দিকী, ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমানে মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং বেকার যুবক লিটন সরকার।