আগামী বুধবার (২ আগস্ট) রংপুরে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন রংপুর বিভাগীয় জনসভায় বক্তব্য রাখবেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দাবি পূরণের আশায় বুক বেঁধেছেন রংপুরের মানুষ। সফরে গিয়ে ৩০টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধনের পাশাপাশি থাকবে নতুন প্রতিশ্রুতিও।
জানা গেছে, এ সফরে ১ হাজার ২৪০ কোটি টাকার ২৭ প্রকল্পের উদ্বোধন এবং নতুন করে আরো ৫টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন রংপুর জিলা স্কুল মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিভাগীয় মহাসমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার আগে তিনি এসব প্রকল্প উদ্বোধন করবেন। বিষয়টি নিশ্চত করেছেন রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান।
জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, কাজ শেষে প্রস্তুত হওয়া শেখ রাসেল মিডিয়া সেন্টার, শেখ রাসেল ইনডোর স্টেডিয়াম, শেখ রাসেল সুইমিং পুল, পীরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন জলাশয়ের জলাবদ্ধতা নিরসন শীর্ষক প্রকল্প, বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, পালিচড়া স্টেডিয়াম, নলেয়া নদী পুন:খনন, আলাইকুমারী নদী পুন:খন, পীরগাছা চৌধুরানী জিসি হতে শঠিবাড়ি আরএইডি ৫৭৯ মি. সড়ক (পীরগাছা অংশ), পীরগঞ্জ ভেন্ডাবাড়ি হতে খালাশপীর জিসি সড়ক পুনর্বাসন, কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুর জিসি হতে পাওটানা জিসি ভায়া ভায়ারহাট সড়ক পুনঃর্বাসন, মিঠাপুকুর উপজেলার জায়গীরহাট-পীরগাছা ভায়া বালারহাট সড়কের গোপালগঞ্জ ঘাটে ঘাঘট নদীর উপর ৯৬ মিটার পিএসসি গার্ডার বিজ্র নির্মাণ, গঙ্গাচড়া উপজেলার বুড়িরহাট জিসি-কাকিনা আরএইডি সড়কে ৪০ মি. আরসিসি ভেরিয়েবল ডেপথ গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ, কাউনিয়া উপজেলায় তিনতলা পল্লীমারী সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম ফ্লাড শেল্টার নির্মাণ, রংপুর মেডিকেল কলেজ মাল্টিপারপাস ভবন, বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় ভবন, মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ ইউনিয়নে ১০ শয্যা বিশিষ্ট বেগম রোকেয়া মর্ডাণ হাসপাতাল, হেলেঞ্চা ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, পীরগঞ্জের চতরা ইউনিয়নে ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, খালাশপীরে ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, মাদারগঞ্জে ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, রংপুর সিটি করপোরেশনের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে গ্রাসফন্ট প্লান্ট ও স্টোর ইয়ার্ড নির্মাণ, ভারারদহ বিল, পাটোয়া কামরী বিল পুন:খন, চিতলী বিল পুন:খন, রংপুর সিটি কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, নৈমুন্না বিল পুনঃখনন এর উদ্বোধন করবেন।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার নির্মাণ, রংপর জেলায় বিটাক কেন্দ্র স্থাপন, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়, রংপুর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অফিস ভবন এবং লেডিস হোস্টেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।
আওয়ামী লীগের রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, রংপুর জিলা স্কুল মাঠে আয়োজিত বিভাগীয় মহাসমাবেশে তিনি এসব উন্নয়নমূলক কাজের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। টানা তিনবার ক্ষমতায় থেকে প্রধানমন্ত্রী রংপুরকে যেভাবে উন্নয়নের মোড়কে সাজিয়েছেন, তা বিগত কোনো সরকার করতে পারেনি। এখন মঙ্গাপীড়িত রংপুর বলা হয় না, কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রতিশ্রুতি পূরণের মধ্য দিয়ে মঙ্গা দূর করেছেন।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাইতে হয় না। তিনি জানেন কখন কী করতে হবে। রংপুরবাসী না চাইতেই ওনার কাছে অনেক কিছু পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রংপুরের উন্নয়ন নিজ কাঁধে নিয়েছিলেন এবং উন্নয়নের মধ্য দিয়ে রংপুরকে বদলে দিয়েছেন। এবারও তিনি রংপুরকে সুখবর দেবেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুর সফরে এসব প্রকল্প ছাড়াও উন্নয়নের জন্য আর কী কী ঘোষণা দিতে পারেন নির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। তবে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, পীরগঞ্জ খালাশপীর কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন, রংপুর মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা, শ্যামপুর চিনিকলসহ বিভাগের বন্ধ চিনিকলগুলো পুনরায় চালু, বিশেষ মেগা প্রকল্প, অর্থনৈতিক জোনসহ প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কিছু দিবেন এমনটা আশা করছেন রংপুরবাসী। তারা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্যদিয়ে রংপুর অঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষিনির্ভর ভারী শিল্প স্থাপন, আর্ন্তজাতিক মানের শিক্ষা, চিকিৎসা, খেলাধুলার সুযোগ তৈরি, শ্যামাসুন্দরী খাল খনন, শিল্পকলকারখানা স্থাপনসহ নানান স্বপ্ন পূরণের ঘোষণা আসবে।
রাজনীতি ও উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, রংপুরের মহাসমাবেশ থেকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন, রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, রংপুর-লালমনিরহাট-পাটগ্রাম-বুড়িমারি মহাসড়ক চার লেনে রূপান্তর, রংপুরে আধুনিক রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ ও ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আসলে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগে পক্ষে একটি বড় ধরণের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের কাছে রংপুরের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হয়ে উঠবেন ঈর্শ্বনীয় উদাহরণ।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও উন্নয়ন বিশ্লেষক উমর ফারুক বলেন, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের দিকে তাকালে রংপুর বিভাগের উন্নয়ন বৈষম্যটা ফুটে উঠে। এই অঞ্চলের মানুষের জন্য উন্নয়নও বরাদ্দ কম, সরকারের কোনো মেগা প্রকল্প নেই। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রীর সফরে পিছিয়ে পড়া রংপুর বিভাগকে এগিয়ে নিতে আরো বেশি উন্নয়নের ঘোষণা আসুক। আমরা উত্তরের টেকসই উন্নয়নে বড় ঘোষণার প্রত্যাশা করছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের সুপারিশ ও চাওয়া থাকবে- রংপুর বিভাগ উন্নয়ন বোর্ড গঠন, তিস্তা মহাপরিকল্পনার জন্য অর্থ বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন, রংপুর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, বন্ধ চিনিকল চালু ও চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য অর্থ বরাদ্দ, আলাদা শিল্প, কর, ভ্যাট, শুল্ক ও ঋণনীতি ঘোষণা, রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, ওয়াসা গঠন, রংপুর সিটি করপোরেশনে প্রয়োজনীয় ও সম্মানজনক বাজেট বরাদ্দ, কর্মসংস্থানভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণে উদ্যোগ গ্রহণ।
রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক রিয়াদ আনোয়ার শুভ বলেন, ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি রংপুর জিলা স্কুল মাঠে এক জনসভায় জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে পাশে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, রংপুরের সার্বিক উন্নয়নের সকল দায়িত্ব আমার কাঁধে নিলাম। পুত্রবধু হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব তো আছে। এক যুগ পরে এসে বলাই যায়, সেদিনের তাঁর সেই ঘোষণা যে নিতান্তই কথার কথা ছিল না তা আজ প্রমাণিত। একথা আজ নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, স্বাধীনতার পরে রংপুরের আক্ষরিক অর্থে সামগ্রিক যা উন্নয়ন হয়েছে তার প্রায় সবই হয়েছে বিগত মহাজোট ও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে। এটা যারা স্বীকার করবে না তারা স্রেফ সত্যের অপলাপ করবে। অনেক উন্নয়ন হয়েছে। শুধু দুইটা তিস্তা সড়ক সেতুর কথা ধরলেই বলা যায়, তিস্তা নদীর উপরে দুই দুইটি সড়ক সেতু নির্মাণ এই অঞ্চলের মানুষের সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
এদিকে বুধবারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রংপুরের মহাসমাবেশ ঘিরে এখন একাট্টা ও উজ্জীবিত রংপুর বিভাগ আওয়ামী লীগ। এই মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে তৃণমূলকে শক্তিশালী করে বিরোধী জোটের মাঠের আন্দোলন মোকাবেলা ও রংপুর বিভাগকে আওয়ামী লীগের ঘাটিতে রুপান্তরের স্বপ্ন নেতাকর্মীদের।
আ.লীগ দলীয় সূত্র জানায়, আর কয়েক মাস পরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগে আগামী দোসরা আগস্ট রংপুরে আসছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে পুরো নগরী। পাড়া-মহল্লায় ও পৌরসভায় মিছিল মিটিংয়ে চলছে আনন্দ উৎসব। জনসভা সফল করতে বাড়ছে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের আনাগোনা। শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতার অবস্থান এখন রংপুরে। এতে অনেকটাই উজ্জীবিত স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এর মাধ্যমেই আগামীতে মিলবে নির্বাচন ও দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদের টিকিট। তাই নাওয়া-খাওয়া ভুলে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিভাগের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এক যুগ পর প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে জনসভাস্থল ১০ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে জনসমুদ্রে পরিণত হবে বলে আশা নেতাদের। রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক একে এম ছায়াদত হোসেন বকুল বলেন, ‘জনসভায় ১০ লাখের বেশি মানুষের সমাগমের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। জনসভায় রংপুর বিভাগের ৫৮টি উপজেলার প্রতিটি উপজেলা থেকে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ হাজার মানুষ আনার প্রস্তুতি রয়েছে। জনসভা সফল করতে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় বর্ধিত সভাও করা হয়েছে।’
রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের আহবায়ক ডা. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এক যুগ পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের মাঝে আসছেন। নিশ্চয়ই উনি এখানে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির ঘোষণা দেবেন। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।’
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ১২ বছর পর রংপুরে আসছেন। অনেকে ভাবছেন উনি কি নিয়ে আসছেন? প্রধানমন্ত্রী আমাদের সবই দিয়েছেন। রংপুরের সব উন্নয়নেই তার অবদান।’
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানক বলেন, ‘১২ বছর পর রংপুরে প্রধানমন্ত্রী আসছেন। তিনি রংপুরের মানুষের কথা শুনবেন। উত্তরবঙ্গের এ অবহেলিত ও মঙ্গাপিড়িত জনপদকে তিনি মুক্ত করেছেন।’
নানক বলেন, মঙ্গাপিড়িত এই অঞ্চলে অভুতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে। এক যুগ পর প্রধানমন্ত্রীর আগমনে উত্তরবঙ্গের জনপদ আজ উৎফুল্ল ও আনন্দিত বলে জানান কেন্দ্রীয় ওই নেতা।