Dhaka Reader
Nationwide Bangla News Portal

এআই কি আমাদের খাবার পানিতে ভাগ বসাচ্ছে ?

আপনি যখন চ্যাটজিপিটি-কে একটি সাধারণ প্রশ্ন করেন, যেমন একটি অংকের সমাধান বা কোনো রেসিপির বিকল্প উপাদান সম্পর্কে জানতে চান, তখন এর পেছনে খরচ হয় এক ফোঁটা বিশুদ্ধ পানি। শুনতে সামান্য মনে হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর ক্রমবর্ধমান ব্যবহার পৃথিবীব্যাপী পানির উৎসের ওপর তৈরি করছে এক নীরব কিন্তু বিশাল চাপ। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই-এর প্রধান স্যাম অল্টম্যানের এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিবিসি’র একটি প্রতিবেদনে এআই প্রযুক্তির এই অনালোচিত দিকটি উঠে এসেছে।

পানির চাহিদা কতটা?
স্যাম অল্টম্যানের মতে, চ্যাটজিপিটি-র সাথে একটি সাধারণ কথোপকথনে এক চা চামচের ১৫ ভাগের এক ভাগ পানি খরচ হয়। প্রতিদিন প্রায় ১০০ কোটি মেসেজের উত্তর দেয় চ্যাটজিপিটি। এর সাথে গুগল-এর জেমিনাই, ডিপসিক বা ক্লড-এর মতো অন্যান্য এআই মডেলগুলোর হিসাব যুক্ত করলে বোঝা যায়, এই চাহিদা বিপুল।

তবে অল্টম্যানের এই পরিসংখ্যান নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাওলেই রেন বলেন, এই হিসাব সম্ভবত কোনো ছোট মডেলের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। তাঁর গবেষণা অনুযায়ী, জিপিটি-৩ এর মতো একটি মাঝারি আকারের মডেলে ১০ থেকে ৫০টি প্রশ্ন করলে প্রায় ৫০০ মিলি বা আধা লিটার পানি ব্যবহৃত হয়। এই পানি মূলত দুটি প্রধান কাজে লাগে:
১. ডেটা সেন্টারের প্রসেসর ঠান্ডা রাখার জন্য।
২. ডেটা সেন্টার চালাতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য।

কেন এত পানি লাগে?
এআই মডেলগুলো জটিল গাণিতিক সমীকরণ সমাধানের মাধ্যমে কাজ করে, যার জন্য প্রয়োজন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটার চিপ। এই চিপগুলো বিশাল আকৃতির ডেটা সেন্টারে রাখা হয় এবং কাজ করার সময় প্রচণ্ড গরম হয়ে যায়।

সরাসরি ব্যবহার: এই হার্ডওয়্যার ঠান্ডা রাখতে লিকুইড কুলিং বা তরল শীতলীকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ বা পানযোগ্য পানি প্রয়োজন হয়, যাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মে সিস্টেমের ক্ষতি না হয়। কুলিং টাওয়ারে এই পানি বাষ্পীভূত করে হার্ডওয়্যার ঠান্ডা রাখা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত পানির প্রায় ৮০ ভাগই বাষ্পীভূত হয়ে পরিবেশে মিশে যায়, যা আর ফেরত পাওয়া যায় না।

পরোক্ষ ব্যবহার: ডেটা সেন্টারের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনেও প্রচুর পানি লাগে। কয়লা, গ্যাস বা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাষ্প তৈরির মাধ্যমে টারবাইন ঘোরানো হয় এবং এই বাষ্প তৈরির জন্য পানি অপরিহার্য। এছাড়া, এআই-এর জন্য প্রয়োজনীয় সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির কারখানাতেও শোধনের কাজে প্রচুর পানি ব্যবহৃত হয়।

পরিবেশ ও সমাজে প্রভাব
এআই-এর জন্য ব্যবহৃত এই বিপুল পরিমাণ পানি প্রায়শই স্থানীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়, যা কৃষি ও মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয়। এর ফলে স্পেন, ভারত, চিলি, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে ডেটা সেন্টার কর্তৃপক্ষের বিরোধ তৈরি হয়েছে এবং অনেক জায়গায় বিক্ষোভও হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির মতে, এআই চালিত ডেটা সেন্টারের বিদ্যুতের চাহিদা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০০% বেড়ে ৩০০ টেরাওয়াট-ঘণ্টায় পৌঁছাতে পারে, যা পুরো যুক্তরাজ্যের এক বছরের বিদ্যুৎ ব্যবহারের সমান। এই বিপুল বিদ্যুৎ ও পানির চাহিদা পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

সমাধানের খোঁজে প্রযুক্তি বিশ্ব
এই সংকট মোকাবেলায় গুগল, মাইক্রোসফট ও মেটা-র মতো বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে নিজেদের “ওয়াটার নিউট্রাল” (যতটুকু পানি ব্যবহার করবে, ততটুকু প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেবে) করার অঙ্গীকার করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সমাধান নিয়ে কাজ করছেন:
নতুন প্রযুক্তি: এমন কুলিং সিস্টেম তৈরির চেষ্টা চলছে যেখানে পানি বাষ্পীভূত হবে না।
স্থান পরিবর্তন: ডেটা সেন্টারগুলোকে মানুষের বসতি থেকে দূরে শীতল অঞ্চলে, যেমন—সাগরের নিচে, মেরু অঞ্চলে বা এমনকি মহাকাশে স্থাপন করার মতো যুগান্তকারী পরিকল্পনা নিয়েও গবেষণা চলছে। এনটিটি ডেটা-র মতো প্রতিষ্ঠান মহাকাশে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ডেটা সেন্টার পরিচালনার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিঃসন্দেহে মানবজাতির জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। তবে এর পরিবেশগত মূল্য, বিশেষ করে পানির ওপর এর প্রভাব, উপেক্ষা করার মতো নয়। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে এর পরিবেশবান্ধব ব্যবহার নিশ্চিত করা এখন সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.