শাহাদৎ হোসেন:
ঢাকা মহানগরী, বাংলাদেশের রাজধানী এবং দেশের প্রাণকেন্দ্র, প্রতিনিয়ত নানা কারণে সড়ক অবরোধের মুখোমুখি হচ্ছে। রাজধানীর যানজটের পরিস্থিতি এতই জটিল যে, দিনের পর দিন সড়ক অবরোধ, রাজনৈতিক-সাংগঠনিক আন্দোলন, শ্রমিক ধর্মঘট এবং নানা দাবিতে সংগঠিত বিক্ষোভ মিছিলের কারণে নগরবাসীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে। সম্প্রতি কয়েকমাস ঢাকার সড়ক অবরোধের কারণে প্রায়ই যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, যা আর্থিক ক্ষতিসহ জনজীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে এবং শহরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমকে স্থবির করে দেয়।
“অটোরিকশার জন্য আলাদাভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ গতির মোটর সরবরাহ করা যেতে পারে। এছাড়াও চালকদের জন্য প্রতি বছর নির্ধারিত ফি নেয়া, যা একটি নিয়মিত রাজস্ব হিসেবে অবদান রাখতে পারে। এই আয় থেকে সড়ক উন্নয়ন, রিকশা স্ট্যান্ড নির্মাণ, চালকদের স্বাস্থ্য সেবা, ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবায় বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে।”
সম্প্রতি, হাইকোর্ট ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল বন্ধ বা এর উপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে নির্দেশ দেয়, যা সড়ক অবরোধের নতুন এক উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ব্যাটারিচালিত অটো চালকরা এবং প্রতিবাদস্বরূপ তারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে মহাসড়ক অবরোধ করেন। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল মহাখালী, বসিলা, রামপুরাসহ আরও কয়েকটি স্থান। যানজটে পড়ে রাজধানীর সড়কগুলো। অপরদিকে মহাখালীতে রেলপথ অবরোধের কারণে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়, যা প্রভাব ফেলেছিল অন্যান্য অঞ্চলে চলাচল করা যাত্রীদের উপর। এই ধরনের আন্দোলনের ফলস্বরূপ, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়, যা শহরের পরিবহন ব্যবস্থা ও জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
এটা প্রথমবারের ঘটনা নয়। কয়েকদিন আগে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে। ১৮ নভেম্বর, সোমবার, তারা মহাখালী রেলগেট এলাকায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। এ সময় ট্রেনে ইট-পাথর ছোঁড়ার ঘটনাও ঘটে, যার ফলে নারী ও শিশুসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এ ছাড়া, গত কয়েক মাস ধরেই ঢাকার অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের দাবির সমর্থনে আন্দোলন করে আসছিল। এতে করেও যানজটের সৃষ্টি হয় নগরীতে।
ঢাকা মহানগরী দীর্ঘদিন ধরেই দেশের সবচেয়ে যানজটপূর্ণ শহরের মধ্যে অন্যতম। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য গণপরিবহন ব্যবহার করে। তবে সড়ক অবরোধ, রাজনৈতিক আন্দোলন এবং বিক্ষোভ মিছিলের কারণে যান চলাচলে বারবার বিঘ্ন ঘটে, যা তাদের যাত্রাপথকে বিপজ্জনক এবং অস্থির করে তোলে। একদিকে, সড়ক অবরোধের কারণে সাধারণ যাত্রীরা আটকা পড়ে, অন্যদিকে, জরুরি সেবার জন্য চলাচলরত অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসক, রোগী, এবং অন্যান্য জরুরি পণ্য পরিবহনকারীরা বিপদে পড়ে। এছাড়া, সড়ক অবরোধের ফলে একদিকে অফিসের কাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে, সড়কপথে চলাচলকারী জনগণের জীবনের মান কমে যায়। বিশেষত, অনেক শ্রমিক, ব্যবসায়ী এবং সরকারি কর্মকর্তারা সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে না পেরে তাদের কাজের দক্ষতা হারান। স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন, শিক্ষা এসব সেক্টরগুলোও সড়ক অবরোধের কারণে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
এমনিতেই প্রতিদিনের যানজট, গণপরহন অব্যবস্থাপনা, এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ শহরের সড়কগুলোকে আরও অচল করে দেয়। বর্তমানে, ব্যাটারিচালিত রিকশা, পরিবহন ধর্মঘট, অপর্যাপ্ত সড়ক অবকাঠামো, এবং সড়কপথের বিভিন্ন সমস্যা ঢাকার যানজট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। ঢাকায় গণপরহন সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ায়, গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আরও যানজট সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং শ্রমিকদের দাবি সমাধানে অক্ষমতা, একদিকে সড়ক অবরোধকে ত্বরান্বিত করে, অন্যদিকে সড়ক অবরোধের মতো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ও প্রশাসন প্রায়ই ব্যর্থ হয়, ফলে আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো সঠিক সময়ে মীমাংসিত হয় না এবং সড়ক অবরোধের ঘটনা বৃদ্ধি পায়।
ঢাকার যানজট ও সড়ক অবরোধের সমস্যা সমাধানে সরকার কিছু স্থায়ী এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে-
পরিকল্পিত নগরায়ণ ও উন্নয়ন: ঢাকাকে একটি পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে সড়ক অবরোধের স্থায়ী সমাধান সম্ভব হয়। শহরের সড়কপথে যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং আরও সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা দরকার। স্মার্ট সিটি ধারণা ও আধুনিক গণপরহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
আইন প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভূমিকা: সড়ক অবরোধের ঘটনা দ্রুত এবং সঠিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আইন অনুসারে, সড়ক অবরোধকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি, তবে পাশাপাশি তাদের দাবির প্রতি উপযুক্ত মনোভাব গ্রহণও প্রয়োজন, যাতে পরিস্থিতি শান্ত থাকে।
দাবি সমাধানে সমঝোতা ও বিকল্প ব্যবস্থা: সড়ক অবরোধকারী সংগঠনগুলোর দাবিগুলোর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সরকারের উচিত সুষ্ঠু আলোচনার মাধ্যমে এসব দাবির সমাধান খুঁজে বের করা, যাতে সড়ক অবরোধের মতো পরিস্থিতি না হয়। শ্রমিকদের অধিকার, পরিবহন সংশ্লিষ্টদের চাহিদা, এবং জনগণের সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে সমাধান করা জরুরি। যেমন অটো চালকদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা কিংবা মূল সড়ক ব্যতিরেকে অলিগলিতে তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে।
সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন: অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ঢাকার সড়কপথকে আরও কার্যকরী এবং ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন সড়ক নির্মাণ, পুরানো সড়ক মেরামত, এবং যাত্রীদের সুবিধার্থে যথাযথ সড়ক চিহ্নিতকরণ প্রয়োজন।
দাবি জানানোর জন্য স্থান নির্ধারণ করা: সরকারের পক্ষ থেকে নগরীর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করা যেতে পারে যেখানে জনগণ তাদের দাবী জানাতে পারবে। এই স্থানটি হবে একটি নিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ এলাকা, যেখানে দাবির সাথে সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন এবং সেখানে আবশ্যক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হবে। এর ফলে মহাসড়কে বিক্ষোভ, অবরোধ বা যেকোনো ধরনের অস্থিরতা তৈরির দরকার পড়বে না, যা যানজট এবং জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করে। এমন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু ও কার্যকর সমাধান দেয়া সম্ভব হবে, যেহেতু জনগণের দাবির প্রতি সরকারের সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করা গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে আন্দোলনকারীরা তাদের দাবী শুনানোর জন্য সহায়ক পরিবেশ পাবে এবং সড়কপথে সাধারণ জনগণের জন্য অপ্রত্যাশিত ক্ষতির সৃষ্টি হবে না।
শিক্ষার্থী, শ্রমিক, অটোচালক কিংবা রাজনৈতিক সংগঠন -কোনো ক্ষেত্রেই সড়ক অবরোধ করে দুই কোটিরও বেশ মানুষের ভাগ্যে কৃত্রিম দুর্ভোগ সৃষ্টি মোটেও সমর্থন যোগ্য নয়। এরআগেও একাধিকবার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। পরিশ্রম কম হওয়ায় প্রযুক্তির এই যুগে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চালকদের যেমন আগ্রহ আছে। তেমনি দ্রুত পৌছানোর কারণে অধিকাংশ যাত্রীদেরও ব্যাটারি চালিত অটোরিকশায় যাতায়াতে আগ্রহ আছে। ইতোমধ্যে একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে যে, ঢাকায় অটোরিকশা বন্ধ করা সম্ভব হবে না; কেননা এর আগের আওয়ামী লীগ সরকারও একাধিকবার অটোরিকশা বন্ধ করেও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারে নি। আর বর্তমানে অধিকাংশ রিকশা চালকরা অটোরিকশার মাধ্যমে তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন; যা একটি বিবেচ্য বিষয় হতে পারে। সেক্ষেত্রে বর্তমান সরকার অটোরিকশা বন্ধ না করে সেগুলো বিআরটিএ কর্তৃক গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা ও অতিরিক্ত গতির জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করলে দুর্ঘটনা কমতে পারে।
এছাড়াও সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে অটোরিকশার জন্য আলাদাভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ গতির মোটর সরবরাহ করেও সংকট থেকে উত্তরণ পাওয়া যেতে পারে। কিংবা নিয়মতান্ত্রিকভাবে মূলসড়কে অটোরিকশা বন্ধ করে অন্য সড়কগুলোতে চালু রাখার বিধিনিষেধ আরোপও করা যেতে পারে। বর্তমানে অটোরিকশা চালকরা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য এই পরিবহন ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। সরকার যদি একটি সিস্টেম চালু করে যেখানে অটোচালকদের জন্য প্রতি বছর নির্ধারিত ফি নেয়া হয়, তবে তা সরকারের জন্য একটি নিয়মিত রাজস্ব হিসেবে অবদান রাখতে পারে। এই আয় থেকে সড়ক উন্নয়ন, রিকশা স্ট্যান্ড নির্মাণ, চালকদের স্বাস্থ্য সেবা, ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবায় বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে। এই প্রকল্পটি যেমন সরকারের জন্য অতিরিক্ত আয় সৃষ্টিতে সাহায্য করবে, তেমনি জনগণের জন্য একটি সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। এতে করে রিকশাচালকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব হবে এবং সড়কপথে নিরাপত্তা ও সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে।