Dhaka Reader
Nationwide Bangla News Portal

কোটা আন্দোলনের সংঘর্ষ সারাদেশে: নিহত ৬, আহত শত শত মানুষ

কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান ছাত্রদের আন্দোলন চলাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষে ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে এ পর্যন্ত। আহত হয়েছেন ছাত্রসহ শত শত মানুষ।

আন্দোলন শুরুর পর থেকে নানা কর্মসূচি দিয়ে চলেছে আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনের ১২তম দিনে গতকাল ১৫ ‍জুলাই প্রথম বড় ধরনের সহিংসতা হয়। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে শত শত মানুষ আহত হয় এদিন। তবে আন্দোলনের ১৩তম দিনটি হলো আরও রক্তক্ষয়ী।

মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রংপুরে একজন, চট্টগ্রামে তিন জন ও ঢাকায় দুজন নিহত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লেও তার কোনও সত্যতা পাওয়া যায়নি।

রাজধানী ঢাকা, রংপুর, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, কুমিল্লা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে কোটাবিরোধীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে বা ঘটে চলেছে। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন শত শত তরুণ-তরুণী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক থাকার পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ চার জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

এছাড়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, পলিটেকনিকসহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্থগিত হয়েছে বৃহস্পতিবার তথা ১৮ জুলাইয়ের এইচএসসি ও সমমানের সব পরীক্ষা।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, নিহত ২

সোমবারের মতো মঙ্গলবারও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এসময় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা মাথায় হেলমেট পড়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে ধাওয়া দেন। উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হতে থাকে। দুই পক্ষ থেকেই ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু হলে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো সায়েন্সল্যাব-নিউমার্কেট এলাকা।

দুপুরের পর ঢাকা কলেজের সামনে এক তরুণকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে রেখে যায় একদল দুস্কৃতকারী। পরে পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়া সিটি কলেজের সামনে আরেক তরুণ আহত অবস্থায় পড়ে ছিল। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকেও মৃত ঘোষণা করেন।

মঙ্গলবার সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর, বাড্ডা, মহাখালী, ফার্মগেট উত্তরা, পুরানো ঢাকা, চানখাঁরপুল এলাকায় কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। ফার্মগেটে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া দেয়। সেখানে সংঘর্ষ শুরু হলে এক পর্যায়ে তা মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর অবরোধ করে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে তাদেরও ধাওয়া দেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। পরে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পুরানো ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে মিছিল নিয়ে আসার সময় সেখানেও সংঘর্ষ হয়। অজ্ঞাত দুস্কৃতকারীদের গুলিতে অন্তত চার জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

মহাখালীতে রেল লাইন অবরোধ করে রেখেছিল আন্দোলনকারীরা। বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ শুরু করে। উত্তরায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করলে সেখানেও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রামে নিহত ৩ জন

মঙ্গলবার সকাল থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে কোটা আন্দোলনকারীরা সড়কে নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন। পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে তিন জন নিহত হয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্র জানায়, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বিকাল ৩টা থেকে নগরীর ষোলশহর স্টেশনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের কথা ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনরীদের। এর আগেই ষোলশহর স্টেশন দখল করে রাখেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। পরে কোটা আন্দোলনকারীরা মুরাদপুরে অবস্থান নেন। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ষোলশহর থেকে মিছিল নিয়ে মুরাদপুর গেলে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে। এতে তিন জন নিহত ও শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নগরীর মুরাদপুর এলাকায় এই সংঘর্ষ শুরু হলেও তা ছড়িয়ে পড়ে বহদ্দারহাট থকে জিইসি মোড় পর্যন্ত। কয়েক কিলোমিটার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

রংপুরে নিহত এক জন

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রংপুর জিলা স্কুল থেকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী কোটা সংস্কার নিয়ে মিছিল বের করেন। মিছিলটি পুলিশ লাইন্সের কাছে এলে পুলিশ মিছিলকারীদের গতিরোধ করে। এ সময় লাঠিচার্জ করে। কিন্তু পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে মিছিলকারীরা নগরীর জাহাজ কোম্পানি এলাকায় এসে নগরীর প্রধান সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে আধা ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন। এরপর বিক্ষোভকারীরা মিছিল নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে এসে বিক্ষোভ করেন।

পরে শিক্ষার্থীরা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ আবারো তাদের গতিরোধ করে। এক পর্যায়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল নিয়ে চার কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করে নগরীর লালবাগ এলাকায় পৌঁছে সেখানে কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে যোগ দেন। পরে মিছিলকারীরা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি এলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের ভেতরে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারীদের ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।

পুলিশ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে দুই পক্ষের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে নিবৃত করার চেষ্টা করে। এ সময় বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবু সাঈদ লুটিয়ে পড়েন। পরে শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে একটি অটোরিকশায় তুলে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

নিহত আবু সাঈদ (২২) বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক। তাজহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল ইসলাম সংঘর্ষে শিক্ষার্থী নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন কিনা, তা জানাতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান আসিফ আল মতিন বলেছেন, পুলিশের ছররা গুলিতে সাঈদ নিহত হয়েছেন।

প্রতিবাদ, হামলা, সংঘর্ষ

ঢাকার অদূরে সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সোমবার দিবাগত রাতে শতাধিক বহিরাগত হাতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে কোটা আন্দোলনকারীদের নির্বিচারে পিটিয়েছে। আন্দোলনকারীরা ভিসির বাসার ভেতরে প্রবেশ করলে বহিরাগতরা ভিসির বাসভবনের প্রধান ফটক ভেঙে সেখানে প্রবেশ করে। মঙ্গলবার সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হল থেকে বেরিয়ে পুরো ক্যাম্পাসে মিছিল করে।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খুলনার দৌলতুপুর নতুন রাস্তা মোড়ে সরকারি বিএল কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে রাখে। বিকেল ৩টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের শত শত শিক্ষার্থীরা শহরের মজমপুরগেটে উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে। এসময় শিক্ষার্থীরা মজমপুর গেটে রেল লাইন ও মহাসড়কের ওপরে বসে বিক্ষোভ করে। এসময় কুষ্টিয়ার সঙ্গে দেশের সর্বত্র রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

কোটাবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে নতুন ভবনের সামনে সাতমাথা-তিনমাথা সড়ক অবরোধ করেন। এ সময় তারা কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। অবরোধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ওই সড়কের উভয় পাশে বিপুলসংখ্যক যানবাহন আটকা পড়ে। পরে পুলিশ প্রশাসনের অনুরোধে কোটাবিরোধীরা ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়েন। এ সময় প্রশাসন ভবনের কিছুটা সামনে হঠাৎ বিকট শব্দে ককটেল বিস্ফোরণ হয়। এতে কলেজের স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমন রানা, মামুন, তাফসির ও মিলন রক্তাক্ত জখম হন।

বেলা ১১টার দিকে টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী টাঙ্গাইল নিরালা মোড়ে অবস্থান নেন। এ সময় কোটাবিরোধী কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে নিরালা মোড়ের দিকে যাওয়ার সময় হামলা ও ধাওয়া করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে নেতৃত্ব দেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান। এ সময় ছাত্রলীগের হামলায় ৩ শিক্ষার্থী আহত হয়। পরে সাধারণ শিক্ষার্থীর একটি গ্রুপ একত্রিত হয় টাঙ্গাইল পৌর উদ্যানে। সেখান থেকে তারা টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। পরে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও এম এম আলী সরকারি কলেজের কয়েকশ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। এই ঘটনায় শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অংশের বিভিন্ন পয়েন্টে অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এরাকায় অবরোধ করে বিএম কলেজ ও ইনফ্রা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বরিশাল কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা। শহরের বিভিন্নস্থানে বিপুল পরিমাণ পুলিশ মোতায়েন করা হলেও আন্দোলনে বাধা দেওয়া হয়নি। সকালে বিএম কলেজ এলাকায় ছাত্রলীগের কিছু কর্মী আন্দোলনকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.