মো. শাহাদৎ হোসেন: দেশের শিল্প অঞ্চল গাজীপুরে শ্রমিক আন্দোলন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর প্রতিটি আন্দোলনের পেছনে রয়েছে একটি মৌলিক দাবি-বেতন। গত কয়েক মাস ধরে গাজীপুর ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকেরা বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে, যা জনগণের জন্য যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি, টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেডের শ্রমিকদের বেতন বকেয়া নিয়ে যে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তা শুধু শ্রমিকদের জীবনে নয়, সাধারণ মানুষের জীবনে অপ্রত্যাশিত দুর্ভোগ তৈরি করেছে। বেতন না পাওয়ার কারণে শ্রমিকেরা সড়ক অবরোধে নামেন, যার ফলে হাজারো যানবাহনের যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে পড়েন। গাজীপুরের সড়কগুলো, বিশেষ করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
এভাবে সড়ক অবরোধ করার পেছনে শ্রমিকদের অসন্তোষের অনেক কারণ রয়েছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বারবার বেতন পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় শ্রমিকেরা অবরোধের মাধ্যমে তাদের দাবি তুলছেন। সড়ক অবরোধের মাধ্যমে তারা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জনগণের কাছে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে চাইছে।
গত ৯ নভেম্বর টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেডের শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ প্রায় ৬১ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। শ্রমিকেরা দাবি করেছিলেন, তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হোক। সড়ক অবরোধের ফলে শুধু কর্মরত শ্রমিকেরা নয়, বরং ওই পথ দিয়ে চলাচলকারী শতশত যানবাহনের হাজারও সাধারণ মানুষও চরম ভোগান্তিতে পড়েন। যানবাহন আটকে থাকার কারণে যাত্রীদের পাশাপাশি পণ্য পরিবহনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। গাজীপুরের মতো ব্যস্ত শিল্প এলাকা যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করে, সেখানে সড়ক অবরোধের এই ঘটনা শুধু শ্রমিকদের নয়, পুরো নগরীকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
আন্দোলনকারীরা বারবার সড়ক অবরোধ করে সরকারের কাছে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি জানান, কিন্তু প্রতি বারেই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান দীর্ঘ সময় নেয়। সাম্প্রতিক আন্দোলনেও সরকার আশ্বাস দিয়েছে যে, আগামী রোববারের মধ্যে এক মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে, কিন্তু তার পরেও এই ধরনের আন্দোলন সাধারণ মানুষের জন্য কেন দায়বদ্ধ? কেন মালিকদের অযোগ্যতা বা অবহেলার কারণে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হবে?
গাজীপুরের শিল্পাঞ্চলের এই ধরনের আন্দোলন নতুন কিছু নয়। গত কয়েক মাসে শ্রমিকদের বেতন না পাওয়ার কারণে অন্তত ২৫ বার মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। শ্রমিকরা যখন তাদের অধিকার আদায়ে সড়ক অবরোধ করে, তখন তা প্রশাসনের চোখে পড়ে এবং কিছু সময়ের মধ্যেই তারা আন্দোলন সমাধান করার আশ্বাস দেয়। কিন্তু এর পরও, মালিকদের পক্ষ থেকে যদি কোনো সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে শ্রমিকদের জন্য আন্দোলন ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
তবে, প্রশ্ন একটাই- শ্রমিকেরা কেন বারবার সড়ক অবরোধের পথ বেছে নিচ্ছেন? কেন তারা সড়ক ছাড়তে দেরি করেন? এমনকি যখন সরকার, শিল্প পুলিশ, কিংবা কারখানা কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দেয়, তখনও আন্দোলন থেমে যায় না। এর মধ্যে বড় একটি কারণ হল শ্রমিকদের প্রতি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং অবিশ্বাসের পরিবেশ। প্রায়ই দেখা যায়, বেতন পরিশোধের জন্য মিটিং এবং আলোচনা হয়, কিন্তু সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাস্তবায়ন ঘটেনি। এতে শ্রমিকদের আস্থা হারিয়ে গেছে এবং তারা অন্য কোনো উপায় না পেয়ে সড়ক অবরোধের মতো চরম পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
এছাড়া শ্রমিকেরা যখন মনে করেন, তাদের আন্দোলন কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছাতে হবে, তখন তারা আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করার জন্য সড়ক অবরোধ করেন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতি আদায় করতে চান, যা প্রমাণ করেছে যে, অনেক সময় প্রশাসনিক পদক্ষেপও তাদের দ্রুত সমাধান আনতে পারছে না।
এদিকে, স্থানীয় শিল্প পুলিশ ও প্রশাসনের মতে, মালিকরা শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে গাফিলতি করলেও, এ ধরনের আন্দোলন সাধারণ মানুষের জন্য খুবই অপ্রত্যাশিত এবং অযাচিত। পুলিশ পরিদর্শক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শ্রমিকেরা বেতন পাওয়ার জন্য সড়ক অবরোধ করলেও, সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা অনেকটাই হ্রাস পায়।
এই ধরনের আন্দোলন শুধু শ্রমিকদের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সড়ক অবরোধের কারণে সাধারণ মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে আটকে পড়েন এবং তাদের দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হয়। পরিবহন মালিকদেরও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ফলে, শ্রমিকদের আন্দোলন একদিকে যেমন তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয়, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এই পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষকে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। মালিকদের উচিত শ্রমিকদের পাওনা সময়মতো পরিশোধ করা, যাতে এই ধরনের অস্থিরতা আর না বাড়ে। একই সাথে, শ্রমিকদেরও নিজেদের দাবি আদায়ে সঠিক পথে আন্দোলন করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ কোনওভাবেই তাদের আন্দোলনের বলি না হয়।
লেখক: সাংবাদিক
সূত্র : শ্রমিকদের বেতন বকেয়া: মালিকদের দায়ে সড়ক অবরোধের বলি সাধারণ মানুষ কেন?