ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক অদ্ভুত ভূখণ্ড এই বাংলাদেশ। এর মাটির গভীরে যেমন উর্বরতার আশ্বাস, তেমনই এর বাতাসে ভেসে বেড়ায় দীর্ঘশ্বাসের লবণাক্ততা। ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তান ভাঙল, জন্ম নিল এক স্বাধীন দেশ। কিন্তু স্বাধীনতা কি আদৌ এল? মানুষ কি পেল সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত শান্তি? উত্তরটা বড় জটিল, বড় বেদনার। প্রতিটি শাসনামলেই সাধারণ মানুষ হয়েছে ঘুঁটি, ক্ষমতার দাবা খেলায় তাদের পিষে ফেলা হয়েছে বারবার।
এক দীর্ঘ রাতের উপাখ্যান ….. ২০০৮ থেকে শুরু
২০০৮ সাল। অনেক অনিশ্চয়তার মেঘ সরিয়ে এক ঝলক আশার আলোর মতোই ক্ষমতায় এল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনটি নিয়ে মানুষের মনে স্বস্তি ছিল; তারা ভেবেছিল, হয়তো এবার পালাবদলের হাওয়া বইবে। কিন্তু সে হাওয়া গতিপথ হারাল খুব দ্রুত। প্রথম পাঁচ বছরের পর গণতন্ত্র যেন এক আনুষ্ঠানিকতার নাম হয়ে গেল। নির্বাচনগুলো পরিণত হলো একতরফা খেলায়, যেখানে বিজয়ী পূর্বনির্ধারিত।
এরপরের পনেরোটি বছর ছিল এক দীর্ঘ রাতের মতো। উন্নয়নের ঝকমকে পরিসংখ্যানের আড়ালে চাপা পড়ে গেল সাধারণ মানুষের আর্তনাদ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্ত আর গরীবের হেঁশেল নিভু নিভু করে জ্বলতে থাকল। আদালত পরিণত হলো ক্ষমতাসীনদের খেলার জায়গায়, যেখানে ন্যায়ের বাণী শুধু কেতাবেই সীমাবদ্ধ।
মাঠ পর্যায়ে লীগ নেতাকর্মীদের দাপটে বিরোধী মত তো বটেই, সাধারণ মানুষও ছিল অসহায়। জমি দখল, চাঁদাবাজি, নির্যাতন আর বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে দেশ ছেয়ে গেল। দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল। মানুষের অধিকার পরিণত হলো দূরের এক মরিচিকায়। ধীরে ধীরে ‘স্বৈরাচার’ শব্দটিই হয়ে উঠল সরকারের সমার্থক। মানুষের মনে জমতে থাকা ক্ষোভ আর হতাশা এক নতুন ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছিল।
প্রত্যাশার সেই ঝড়
সেই ঝড়ের নাম ছিল ‘ছাত্র আন্দোলন’। ২০২৪ সালে কোটা সংস্কারের ছোট্ট এক দাবি নিয়ে যে স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল, তা খুব দ্রুতই দাবানলে রূপ নেয়। এই আন্দোলন আর শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না; তা হয়ে উঠল স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আপামর জনতার এক সম্মিলিত গর্জন। “এক দফা, এক দাবি – হাসিনার পদত্যাগ” স্লোগানে প্রকম্পিত হলো সারাদেশ।
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এল। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট। ছাত্র-জনতার উত্তাল স্রোতের মুখে টিকে থাকতে না পেরে দীর্ঘ পনেরো বছরের শাসক শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিলেন ভারতে।
সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকার রাস্তায় নেমেছিল মানুষের ঢল। তাদের চোখেমুখে ছিল মুক্তির উল্লাস, বুকে ছিল এক নতুন সকালের স্বপ্ন। তারা ভেবেছিল, এই তরুণেরাই দেশের ভাগ্য বদলাবে। যারা কোনো রাজনৈতিক দলের কলুষতার অংশ নয়, সেই যুবকদের হাতেই গড়ে উঠবে এক নতুন বাংলাদেশ। যেখানে গরীব তার অধিকার পাবে, ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো, আর মানুষ বুক বাঁধল এক সোনালি ভবিষ্যতের আশায়।
যে যায় লঙ্কায়…
কিন্তু প্রবাদ যে বড় নির্মম সত্য! “যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ।”
শেখ হাসিনার পতনের পর এক বছরও পেরোয়নি। যে ছাত্রদের মানুষ দেবদূতের মতো বরণ করে নিয়েছিল, তাদেরই ভিন্ন এক রূপ প্রকাশ পেতে শুরু করল। ক্ষমতার স্বাদ, অর্থের লোভ আর প্রতিপত্তির মোহ সেই বিপ্লবী তরুণদের গ্রাস করতে থাকল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকা ছাত্র প্রতিনিধি থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ে থাকা নেতারা – অনেকেই জড়িয়ে পড়ল পুরোনো সেই চেনা খেলায়।
দুর্নীতির অভিযোগ উঠল তাদের বিরুদ্ধে, যারা একদিন দুর্নীতির বিরুদ্ধেই স্লোগান দিয়েছিল। স্বচ্ছতার কথা বলা মুখগুলোই চাঁদাবাজির নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করল। এতদিন যারা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ ছিল, সেই দলগুলোও তাদের পুরোনো রূপে ফিরে এল। দেশজুড়ে আবারও শুরু হলো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার রাজনীতি, হত্যা, আর ক্ষমতার দম্ভ।
সাধারণ মানুষ স্তব্ধ হয়ে দেখল, কেবল শাসকের মুখ বদলেছে, শাসন বদলায়নি। তাদের আশার প্রাসাদে আবারও বালি মিশে গেল। স্বপ্নগুলো কাঁচের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
আজ তারা কার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে? কে আসবে তাদের ত্রাণকর্তা হয়ে? চারদিকে কেবল রাবণের উল্লাস, ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে চলছে নির্লজ্জ কামড়াকামড়ি। আর এর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এক অসহায় জনতা, যারা আবারও এক মিথ্যা ভোরের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। এই রাবণের দ্বীপে কি আদৌ কোনোদিন কোনো রাম আসবে? নাকি এভাবেই এক রাবণের পতনের পর নতুন রাবণের উত্থান দেখতে দেখতেই কেটে যাবে আরেকটি শতাব্দী? উত্তরটা সময়ের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে।