কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন টাঙ্গাইলের করটিয়ার ঐতিহ্যবাহী পন্নী পরিবারকে ঘিরে বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট রিয়াদুল হাসান।
রবিবার (৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫) রিয়াদুল হাসান নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে তিনি টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী পন্নী পরিবারের প্রতি কাদের সিদ্দিকীর আচরণকে ‘অবিচার’ ও ‘অমানবিক’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং এর পেছনে জমি দখলের উদ্দেশ্য ছিল বলে দাবি করেছেন। রিয়াদুল হাসানের এই ফেসবুক পোস্টটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
মি. সিদ্দিকী, পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়ে না। একশ বছর আগে করলেও না, একশ বছর পরে করলেও না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকার জন্য মানুষ আপনাকে চিনে। কিন্তু সেসময় বহু নির্দোষ মানুষেরও প্রাণহানি আপনি ঘটিয়েছেন, জীবন ধ্বংস করেছেন, সম্মানহানি ঘটিয়েছেন। কোনো মবকে সমর্থন করি না। আপনার বাড়ি হামলা হয়েছে, সর্বত্র মবের রাজত্ব চলছে- এটা উদ্বেগজনক। কিন্তু এহেন মবের সূত্রপাত আপনারা ঘটিয়েছেন।
আপনি আপনার বইয়ে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী পন্নী জমিদার পরিবারের বিরুদ্ধে রাজাকারি করার অপবাদ আরোপ করেছেন। কিন্তু সেগুলো ছিল সর্বৈব মিথ্যা। আপনার প্রজন্মের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও গণমান্য ব্যক্তির মুখে আমরা সে সময়ের কথা শুনেছি। অনেকে সেমিনারে এসে পাবলিক স্পিচে আপনার এই মিথ্যা অপবাদ খণ্ডন করেছেন। একজনও বলতে পারেন নাই যে, করটিয়ার জমিদার মাহদি আলী খান পন্নী বা তাঁর সন্তান মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বা রাজাকারদেরকে সহযোগিতা করেছেন। বরং তারা নিজেরাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গৃহবন্দী ছিলেন নয়টি মাস।
বিষয়টি বোঝার আছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন এবং পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের রাজনীতিতে পন্নী পরিবারের বিরাট অবদান ছিল। তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী বৃহৎ ময়মনসিংহ অঞ্চলে নিজেদের ঘাঁটি হিসাবে বেছে নিয়েছিল প্রাচীর বেষ্টিত সুরক্ষিত দুর্গের মতো পন্নী পরিবারের জমিদারবাড়ি। শুরুতেই তারা এসে এই বাড়িগুলো দখল করে নেয় এবং বাড়ির সবাইকে গৃহবন্দী করে ফেলে। এ সময় তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এলাকার বহু হিন্দু, মুসলমানের জীবন রক্ষা করেছেন। তারা চাইলে যুদ্ধের আগেই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে পারতেন কিন্তু সাধারণ মানুষের অনুরোধে তারা তাদের সঙ্গে থেকেছেন এবং তাঁদেরকে গণহত্যার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। এখনও সে সময়ের যে সব মানুষ বেঁচে আছেন, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে এই সত্যটাই বেরিয়ে আসবে।
টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে আমি নিজে টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল হক মোহনের মুখে শুনেছি, যুদ্ধ শুরু হওয়া আগেই মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী নিজে তাঁদের বাড়িতে রক্ষিত ব্রিটিশ আমলে শিকারের কাজে ব্যবহৃত পারিবারিক অস্ত্রাগারের অস্ত্রগুলো এনে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন পাক হানাদারদের প্রতিরোধ করার জন্য।
শুধু তাই নয়, তাঁর বোন আমেনা পন্নী আমেরিকায় অবস্থিত পাকিস্তানের কনস্যুলেট ভবনে ঢুকে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন মার্চের ২৮ তারিখে। পন্নী পরিবারের আরেক সদস্য খুররম খান পন্নী ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য কূটনৈতিক লড়াই চালিয়েছিলেন। অথচ আপনি তৎকালীন জমিদার মেহেদী আলী খান পন্নীকে তাঁর দুই ছেলে সহ মাইলের পর মাইল কোমরে দড়ি বেঁধে হাঁটিয়েছেন। তাঁদেরকে ময়মনসিংহের গভীর জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছিলেন হত্যা করার জন্য। অথচ তারা ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ, তারা ছিলেন ঐ এলাকায় শত শত বছর ধরে জমিদার যাদের প্রতি সম্মানে শ্রদ্ধায় এলাকার মানুষ ছিল ভক্তিবিনয়ে পূর্ণ।
মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর স্ত্রী বেগম মরিয়ম সাত্তার তখন গর্ভবতী। তাঁর স্বামী শ্বশুরকে হত্যা করা হয়েছে এমন শংকা অথবা দুঃসংবাদ পেয়ে সহ্য করতে না পেরে তাঁর গর্ভের সন্তান অকাল গর্ভপাতে মৃত্যুবরণ করে। এমন আরো বহু নিষ্পাপ মানুষের রক্তে আপনার হাত রঞ্জিত। জমিদার পরিবারের সদস্যদের মুখে শুনেছি, আপনি এই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন কেবল জমিদার পরিবারের জমি দখল করার জন্য। এর প্রমাণ আপনার পরবর্তী কর্মকাণ্ড। পন্নী পরিবারের কত জমি আপনি গ্রাস করেছেন সে কথা টাঙ্গাইলের মানুষ জানে।
আপনার আজীবন সঞ্চিত পাপের ফল এখন আপনি পাচ্ছেন। আপনার অহঙ্কারের শাস্তি আপনি দুনিয়াতেই পাবেন। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আপনি যাদেরকে শোষণ করেছেন, যাদেরকে অপমানিত লাঞ্ছিত করেছেন, তাদের আত্মার বদদোয়া আপনাকে বংশ পরম্পরায় তাড়া করবে।
আপাতত নিজের দুর্দশার জন্য সমবেদনা নেওয়ার চেষ্টা করেন। হয়ত সমবেদনা পাবেন কিছু। কিন্তু পাপ তার বাপকেও ছাড়বে না। টুপি মাথায় দিয়ে, দাড়ি রেখে যতই দরবেশ সাজুন না কেন, মৃত্যুর আগে চরম অসম্মান আর লাঞ্ছনা আপনাকে অবশ্যই ঘিরে ধরবে। কারণ আপনারা নিরপরাধ মানুষের উপর অনেক অন্যায় করেছেন। সেগুলো একদিন অবশ্যই প্রকাশ পাবে।”