কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত শুক্রবার নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় কারাগারে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেইসঙ্গে ভেতরে ঢুকে সেলের তালা ভেঙে দিলে ৯ জঙ্গিসহ ৮২৬ কয়েদি পালিয়ে যায়। পাশাপাশি অস্ত্র-গোলাবারুদ ও খাদ্যপণ্য লুট এবং ব্যাপক ভাঙচুর করে হামলাকারীরা।
গত শনিবার কারাগারে গিয়ে হামলা ও ভাঙচুরের দৃশ্য দেখা যায়। কারাগারের পুরো চত্বরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ইটপাটকেল, কারাগারের বিভিন্ন স্থাপনার ভাঙা জিনিসপত্র। কারা কর্তৃপক্ষ বলছেন, আগামী এক বছরেও কারাগারটিতে পুরোপুরি বসবাসের উপযোগী করা তোলা যাবে না। কারণ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
যেভাবে হামলার সূত্রপাত:
নরসিংদী জেলা কারাগারটি শহরের ভেলানগরের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত। ভেলানগর ও জেলখানা মোড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা গত কয়েকদিন ধরে লাগাতার বিক্ষোভ-সমাবেশ করছিলেন। শুক্রবারও সেখানে কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ করে। তবে সেদিন সাধারণ শিক্ষার্থীদের খুব একটা দেখা যায়নি। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে হঠাৎ করেই হাজারো জনতা কারাগারের দিকে এগোতে থাকে। তারা গিয়ে সেখানে প্রথমে ইটপাটকেল, পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। সেইসঙ্গে কারা ফটকে ভাঙচুর চালায়।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে একাধিক কারারক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বিকাল সোয়া ৪টার দিকে হামলাকারীরা ইটপাটকেল ছুড়তে ছুড়তে কারাগারের দুই দিকের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। এ সময় পেট্রলবোমা ছোড়া হয়। এতে কারাগারের ভেতরে নানা জায়গায় আগুন ধরে যায়। হামলাকারীদের হাতে লাঠিসোঁটা, দেশি অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র ও শাবল, কুড়াল ছিল। তাদের হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা করেন কারারক্ষীরা। তবে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় কারারক্ষীরা নিরাপদ অবস্থানে চলে যান। হামলাকারীরা কারারক্ষীদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া চাবি দিয়ে বন্দিদের অনেকগুলো কক্ষের তালা খুলে দেয়। কিছু কক্ষের তালা ভেঙে ফেলা হয়। চারপাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। এ সময় হামলাকারীরা আসামি ছিনিয়ে নেয়। এরপর একে একে ৮২৬ বন্দি পালিয়ে যান। এ সময় অস্ত্রাগার ও কারারক্ষীদের থেকে ৮৫টি অস্ত্র ও আট হাজার ১৫০টি গুলি লুট করা হয়।
দুজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, হামলাকারীরা শাবল, কুড়াল ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কারা ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল। মূল সেলের প্রবেশমুখে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তালা ভেঙে বন্দিদের মুক্ত করে দেয় তারা। পরে কারা হাসপাতালে আগুন দেয়। বিকাল থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সেখানে থমথমে পরিবেশ ছিল।
কারারক্ষীরা জানিয়েছেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যে কয়েদিরা পালিয়ে যায়। এর মধ্যে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৯ সদস্য ছিল; যাদের মধ্যে দুজন নারী। কোনও কোনও সাধারণ কয়েদি পালিয়ে যেতে না চাইলে তাদের মারধর করে জেল থেকে বের করে দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা কারাগারের পোশাক নিয়েই পালিয়ে যায়। কারারক্ষীরা পিছু হটার পর অস্ত্রভান্ডার ভেঙে মোট ৮৫টি অস্ত্র ও আট হাজার ১৫০টি গুলি লুট করে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। এ সময় কারাগারের ভেতরে কয়েদিদের থাকা খাবারও লুট করা হয়। বন্দিদের কাছে থাকা টাকাও ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে।
কারাগার যেন ধ্বংসস্তূপ:
শনিবার দুপুরে কারাগারে গিয়ে দেখা যায়, পুরো কারাগার যেন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। বন্দিদের থাকার জায়গা, রান্নাঘর, কনডেমড সেল ও অফিস এখন আর আলাদা করে চেনার উপায় নেই। সবখানে পোড়া চিহ্ন, লন্ডভন্ড অবস্থা। দেখে মনে হয়, যুদ্ধক্ষেত্রের কোনও ধ্বংসস্তূপ। দরজা-জানালাগুলো ভেঙে গেছে, কোথাও কোথাও আগের দিনের লাগানো আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। দেয়ালে দেয়ালে ছিল পোড়া চিহ্ন।
বিভিন্ন কর্মকর্তাদের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, নথিপত্র পুড়ে গেছে। অনেক আসবাবপত্রে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। কয়েদিদের সেলগুলো খোলা অবস্থায় রয়েছে। কারাগারের ভেতরে থাকা বাগানটিও তছনছ অবস্থায় দেখা গেছে। কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাদা পোশাকে আছেন। কারাগারের অফিস, রান্নাঘর, বন্দিদের থাকার জায়গা, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের থাকার কনডেমড সেলসহ পুরো এলাকায় আগুনে পোড়ার দাগ। আশপাশের উৎসাহী লোকজন কারাগারের ভেতরে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন।
বন্দিদের কারাগার থেকে চলে যাওয়ার সময়কার কথা উল্লেখ করে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘বের হয়ে যাওয়ার সময় বন্দিদের অনেকে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এক বন্দি তাকে বলেছেন, তার ২৪ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। ১০ বছর সাজা খেটেছেন। তিনি এখন সুযোগ পেয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন।’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, কারাগারের ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতে দুর্বৃত্তদের সময় লেগেছে অন্তত ২০ মিনিট। এ সময়ের মধ্যে কারারক্ষীরা কোনও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেননি। এমনকি দুর্বৃত্তদের দিকে গুলি ছোড়েননি। অবশ্য দুর্বৃত্তের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। বলতে গেলে কয়েক হাজারের বেশি।
এদিন দুপুরে ভেতরে দেখা মেলে কয়েকজন কয়েদির। অরক্ষিত কারাগারে শঙ্কা আর উদ্বেগ নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরছিলেন তারা। এর মধ্যে এক কয়েদি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘হত্যা মামলায় আমার সাজা হয়েছিল। সেই সাজা প্রায় শেষের দিকে। এ অবস্থায় পালিয়ে গিয়ে নতুন করে মামলার আসামি হতে হবে। এজন্য বাড়তি সাজার ভয়ে পালিয়ে যাইনি। যা হবার হবে এই ভেবে এখানেই থাকছি।’
মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আরেক কয়েদি বলেন, ‘আমার আর দুই মাসের সাজা বাকি। এ অবস্থায় পালিয়ে বাইরে চলে গেলে নতুন করে সাজা খাটতে হবে। তাই সুযোগ পেলেও পালিয়ে যাইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা কারাগারে হামলা চালিয়েছে তাদের দেখে শিক্ষার্থী মনে হয়নি। আমরা যারা পালাতে চাইনি, আমাদের জেলগেট দিয়ে জোর বের পিটিয়ে বের করা হয়েছে। সন্ধ্যার দিকে দুর্বৃত্তরা চলে যাওয়ার পর আমরা পুনরায় জেলখানায় প্রবেশ করি। পরে জেলার ও জেল সুপারের সঙ্গে কথা বলি।’
জেলা কারাগারের জেলার কামরুল ইসলাম বলেন, ‘যখন কারারক্ষীদের কাছ থেকে চাবি ছিনিয়ে নেওয়া হয় তখন তাদের মারধরও করা হয়। চাবি নিয়ে সেলে গিয়ে সেগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং সেখানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। গত ১৪০ বছরের ইতিহাসে কারা অভ্যন্তরে বন্দিদের বিদ্রোহের ইতিহাস থাকলেও বাইরে থেকে বন্দিদের ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম। তাদের হামলায় ৭৫ কারারক্ষীর মধ্যে ২০ জন আহত হন।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নরসিংদী কারাগারের জেল সুপার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘খুব অল্প সময়ের মধ্যে দুর্বৃত্তরা আমাদের জিম্মি করে ফেলেছিল। আমরা অস্ত্রাগারে পৌঁছানোর আগেই দুর্বৃত্তরা সেখান থেকে অস্ত্র ও গুলি লুট করে নিয়ে যায়। জেলা পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েও সাড়া পাইনি আমরা।’
জেল সুপার ও জেলার সাময়িক বরখাস্ত:
এদিকে, কারাগারে হামলা ও বন্দিদের পালানোর ঘটনায় জেল সুপার আবুল কালাম আজাদ ও জেলার কামরুল ইসলামকে মঙ্গলবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। নরসিংদীর জেলা প্রশাসক বদিউল আলম বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কারাগারে হামলার ঘটনায় গত রবিবার দুপুরে জেলার কামরুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে নরসিংদী মডেল থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, হামলায় অংশ নিয়েছেন ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার ব্যক্তি। তবে ভেতরে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছেন অন্তত এক হাজার লোক।’
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের আত্মসমর্পণের জন্য এলাকায় এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। তারা দু-একজন করে আসছেন। আমাদের ধারণা, বেশির ভাগ বন্দি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করবেন।’
কারাগার পরিদর্শনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী:
মঙ্গলবার বেলা ২টার দিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া কারাগার পরিদর্শনে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ সময় তার সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মশিউর রহমান, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম, আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এফ এম আনিসুল হক, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি নুরুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক বদিউল আলম, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
কারাগার ঘুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘৯ জন জঙ্গিসহ ৮২৬ জন বন্দিকে কারাগার থেকে মুক্ত করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। অস্ত্রাগার থেকে ৮৫টি অস্ত্র ও হাজার হাজার গুলি লুট করা হয়। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা দেশের শত্রু। তাদের গ্রেফতারে পুলিশের চিরুনি অভিযান চলছে।’
দুটি তদন্ত কমিটি:
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কেন এই ঘটনা ঘটলো, কারও গাফিলতি আছে কিনা, কেউ এখানে সহযোগিতা করেছে কিনা—এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তিন সদস্যের কমিটি করেছেন আইজি প্রিজন। আর ছয় সদস্যের কমিটি করেছে সুরক্ষা সেবা বিভাগ। যদি কারও গাফিলতি থাকে, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’
বন্দির আত্মসমর্পণ:
বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ৮২৬ জন বন্দির মধ্যে ৩২৬ জন আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। গত তিন দিনে তারা আত্মসমর্পণ করেন। নরসিংদী জেলা আইনজীবী সমিতি এই তথ্য জানিয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জেলা কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া পাঁচ জন বন্দি থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন এবং চার জন পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার হয়েছেন। এ নিয়ে কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ৮২৬ বন্দির মধ্যে ৩০৭ জনকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
জেলা আইনজীবী সমিতির কোষাধ্যক্ষ আহমুদুল হক জানান, সোমবার থেকে বন্দিরা আত্মসমর্পণ করার জন্য আদালতে আসা শুরু করেছেন। মঙ্গলবার ১৩৮, বুধবার ১২৩ এবং বৃহস্পতিবার ৬৫ জন আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাদের মধ্যে বেশকিছু সাজাপ্রাপ্ত ও হত্যা মামলার আসামি ছিলেন।
জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় পুলিশের অভিযানে কারাগারের অস্ত্রাগার ও কারারক্ষীদের কাছ থেকে লুট হওয়া আরও ছয়টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে ৩৯টি অস্ত্র ও এক হাজার ৬৭টি গুলি উদ্ধার হয়েছে। বাকি অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারে এবং জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।