ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের রশি টানাটানি কেন?
বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামপন্থী দল হিসেবে পরিচিত ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিজেদের সাথে রাখার জন্য এক ধরনের রশি টানাটানি শুরু হয়েছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং তার সাবেক জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী। ধর্মীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থান এবং উদ্দেশ্য নিয়ে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
বৈঠক ও সমঝোতার পর পরিস্থিতি-
চরমোনাই পির হিসেবে পরিচিত ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের সাথে এক সপ্তাহের ব্যবধানে জামায়াতের আমীর শফিকুর রহমান এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাক্ষাতের ঘটনা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোচনা তৈরি করেছে। এই বৈঠকের পর চরমোনাই পির এবং বিএনপি মহাসচিবের মধ্যে দশ দফা একমত হওয়ার কথা ঘোষণা করা হলেও জামায়াত বলছে, তারা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সাথে জোট গড়ার জন্য আলোচনার প্রক্রিয়া এখনও চলমান রেখেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, “বিএনপি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, এবং সবার সাথে যোগাযোগ ও আলোচনা অব্যাহত রাখে।” অন্যদিকে, বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল মন্তব্য করেন, “জামায়াত হঠাৎ করে বিভিন্ন দলকে নিজেদের পাশে টানার চেষ্টা করছে, কারণ তারা জানে যে, অন্য দলগুলোর সহায়তা ছাড়া তারা নির্বাচনে সফল হতে পারবে না।”
জামায়াতের আগ্রহ ও ইসলামী আন্দোলনের সাথে আলোচনা-
জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ জানান, “ইসলামী দলগুলোর সাথে জামায়াতের আলোচনা অব্যাহত আছে এবং একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তবে, এতে অন্য কোনো দলের সাথে একমত হতে বাধা নেই।” জামায়াতের নেতারা এই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি সম্ভাব্য জোট গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মন্তব্য-
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে এই রশি-টানাটানি মূলত বাংলাদেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় ধর্মের গুরুত্ব এবং ধর্মভিত্তিক দলগুলোর জোটের ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল। জোবায়দা নাসরিন, একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বলেন, “এটি বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতির একটি পুরোনো অভ্যাস। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর গুরুত্ব কখনোই কম নয়, বিশেষত যখন তারা বড় রাজনৈতিক দলের সাথে জোট গঠন করে।”
বিএনপি এবং জামায়াতের মতবিরোধ এবং অবস্থান-
গত বছর আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে কিছু মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল। বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে থাকলেও জামায়াত সংস্কারের পক্ষে ছিল। এর ফলে দু’দল একে অপরকে আক্রমণ করতে শুরু করেছিল, এমনকি জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান ২৭শে ডিসেম্বর এক কর্মী সম্মেলনে বিএনপির ওপর এক তীব্র আক্রমণ করেছিলেন। তবে, বিএনপির নেতারা বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দলের সাথে যোগাযোগ রাখতে সক্ষম হয়েছেন, যা আসন্ন নির্বাচনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক-
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপির এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যেখানে জামায়াতের পাশাপাশি খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, এবং নেজামে ইসলামসহ আরও বেশ কয়েকটি দল রয়েছে। এদের সঙ্গে বিএনপি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই যোগাযোগ বিএনপির জন্য একটি কৌশল হতে পারে যাতে ধর্মভিত্তিক দলগুলো তাদের বিরুদ্ধে না গিয়ে তাদের পক্ষে আসে।
তৃতীয় পক্ষের সমর্থন এবং সঙ্কট-
একদিকে বিএনপি ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে চাচ্ছে, অন্যদিকে জামায়াতও সেই সম্পর্ক রক্ষা করার জন্য নিজেদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মঞ্চ গঠিত হলে, তা বিএনপির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি হয়তো ইসলামপন্থী দলগুলোর সহায়তা চাইতে চাইছে যেন তারা তাদের বিরুদ্ধে না গিয়ে, বরং বিএনপির সাথে থাকুক।
আসন্ন নির্বাচনের পরিস্থিতি-
এখন পর্যন্ত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা হয়নি, তবে কিছু সময়ের মধ্যে তা ঘোষণা হতে পারে। বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে এই ধরনের যোগাযোগ নির্বাচনের কৌশল হিসেবে দেখা যাচ্ছে, যেখানে তারা নিজেদের জন্য সমর্থন এবং ভোট চাইছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচনের আগে বিএনপি তাদের ক্ষমতাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সহায়তা নিয়ে আসতে পারে, এবং জামায়াত তাদের এককভাবে কোনো নির্বাচনী সুবিধা পাওয়ার আশায় কাজ করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সমর্থন নিয়ে তৈরি হওয়া রশি-টানাটানি বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে। ধর্মের প্রভাব এবং দলগুলোর জোটের গুরুত্ব নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, এবং এটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ল্যান্ডক্সেপ এর পরিবর্তন ঘটাতে পারে।