প্রতিদিন অন্তত অর্ধকোটি টাকার বালু লোপাট হচ্ছে শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার অতিগুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি নদী ভোগাই থেকে। ভারত সীমানা ঘেঁষে নদীর তীর ভেঙে ও গভীর গর্ত খুঁড়ে অবৈধ এ বালু উত্তোলনের ফলে হুমকীতে পড়েছে জেলার একমাত্র স্থলবন্দর ‘নাকুগাঁও স্থলবন্দর’ এবং সীমান্ত সড়কে নির্মিত ‘ভোগাই ব্রিজ’। বারবার বিষয়টি অবহিত করার পরও অজ্ঞাত কারণে নড়ছে না উপজেলা প্রশাসন। বালু উত্তোলনের সাথে জড়িতরা জানিয়েছেন, ইউএনও’র অনুমোতি নিয়েই তোলা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বালু। অথচ জেলা প্রশাসক বলছেন, এভাবে বালু উত্তোলনের কোন সুযোগ নেই।
সূত্রমতে, চলতি বাংলা সনে এক বছরের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে নালিতাবাড়ির ভোগাই নদীর ৫টি মৌজায় মোট ৯ একর ৮২ শতাংশ জায়গা থেকে বালু উত্তোলনের জন্য বালু মহাল ইজারা দেয়া হয়। ৯৬ লাখ ৮৬ হাজার টাকায় কালাকুমা, হাতিপাগার, ফুলপুর নয়াবিল ও মন্ডলিয়াপাড়ায় বালু মহালটি ইজারা নেয় জিলানী এন্টারপ্রাইজ। এ সময় বেশকিছু বালু ব্যবসায়ী নাকুগাঁও, কালাকুমা ও তারানী মৌজার নিষিদ্ধ সীমানা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চালিয়ে আসছিল। ফলে গেল ২৭ জুন ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে উপজেলা প্রশাসন প্রায় ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৭৯৬ ঘনফুট বালু জব্দ করে। ওই সময় জব্দকৃত ওই বালুর পরিমাণ ৩০ লাখ ঘনফুট বলে গণমাধ্যমকে জানানো হয় এবং এর বাজার মূল্য দেখানো হয় প্রায় ৬ কোটি টাকা। পরবর্তীতে দুই দফায় জব্দকৃত বালু পরিমাপ করে ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৭৯৬ ঘনফুট নির্ধারণ করা হয়।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জব্দকৃত বালু রাতের আধারে লুটপাট হতে থাকে। এমতাবস্থায় গত ৮ জুলাই জব্দকৃত ওই বালু নিলাম দেয় উপজেলা প্রশাসন। নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে সবমিলিয়ে ১ কোটি ১৮ লাখ টাকায় ক্রয় করেন কামরুজ্জামান নামে এক ব্যক্তি। মূলত কামরুজ্জামানের নামে নিলাম পেলেও এর পেছনে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে অনেকে শেয়ার রয়েছেন।
সরেজমিনে জানা যায়, নিলামে নেওয়ার পর জব্দকৃত ওই বালু অপসারণ না করে নদীর নিষিদ্ধ সীমানা ভারত ও স্থলবন্দর সংলগ্ন নাকুগাঁও, উত্তর কালাকুমা ও তারানী এলাকায় ৯০-১০০টি শ্যালুচালিত মিনি ড্রেজার বসানো হয়েছে। নদীর তীর ভেঙে ও নদীতে নিয়মবহির্ভূতভাবে গভীর গর্ত খুঁড়ে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। এর ফলে নদীর পশ্চিম তীরে থাকা নাকুগাঁও স্থলবন্দর, পুলিশের ইমিগ্রেশন, নাকুগাঁও কাস্টমস কর্মকর্তার কার্যালয়সহ সরকারী বহু স্থাপনা হুমকীতে পড়েছে। নাকুগাঁও ব্রিজের পিলারের নিচে থাকা পায়ার পেরিয়ে পাইলিং পর্যন্ত বেরিয়ে পড়েছে। ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে সীমান্ত সড়কে নির্মিত জনগুরুত্বপূর্ণ ব্রিজটি। হুমকীতে নদী পারের বাসিন্দারা।
বালু বিক্রিতে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি ড্রেজিং সেটে রাত-দিন বালু উত্তোলন করলে স্থানভেদে ২-৩ ট্রাক বালু উত্তোলন করা যায়। বর্তমানে এক ট্রাক বালুর মূল্য ট্রাকের সাইজভেদে ৩০-৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। সে হিসেবে প্রতিটি ড্রেজিং সাইটে প্রতিদিন গড়ে অন্তত এক থেকে দেড় লাখ টাকার বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আর এ হিসেবে পুরো নিষিদ্ধ এলাকা হতে প্রতিদিন লোপাট হচ্ছে কমপক্ষে অর্ধকোটি টাকার বালু। যা অন্যান্য সময়ে কয়েক মাসের সমান। শুধু তাই নয়, ওইসব বালু বিক্রির পাশাপাশি আগের চেয়ে দ্বিগুণ হারে নিজেদের ছাপানো রশিদ বইয়ের মাধ্যমে তোলা হচ্ছে রয়েলিটিও।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বালু উত্তোলনকারীরা জানান, এ স্থানটি ডাকের মাধ্যমে বালু উত্তোলনের অনুমোতি দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একই কথা বলেন বিজিবি’র দায়িত্বে থাকা সদস্যরা।
এদিকে উপজেলা প্রশাসন থেকে নিলামে তোলা জব্দকৃত বালু অপসারণের জন্য ১৪ আগস্ট থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক মাস সময় বেধে কিছু শর্তাবলি উল্লেখ করা হয়েছে। ওইসব শর্তের মধ্যে ১ নং শর্তে বলা হয় ‘নাকুগাঁও ব্রিজের উত্তর ও দক্ষিণে ৫শ মিটার করে মোট ১ কিলোমিটার এলাকা হতে বালু উত্তোলন করা যাবে না।’ ২ নং শর্তে উল্লেখ করা হয় ‘ নদীর পার, কৃষি জমি ও বসতবাড়ির ক্ষতি সাধন করে বালু উত্তোলন করা যাবে না।’ সবশেষ ৬ নং শর্তে উল্লেখ করা হয় ‘উল্লেখিত শর্তসমূহ ভঙ্গ করলে নিলাম বাতিল ও সমুদয় অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হবে।’
উপরোক্ত কৌশলী দুটি শর্তের আলোকে নিলাম প্রাপ্তরা ভোগাই নদীর নিষিদ্ধ এলাকাসমূহ হতে গত ৮ জুলাই থেকে দিনে-রাতে দেদারসে বালু উত্তোলন করছে। অথচ ওইসব শর্ত জুড়ে দেওয়ার কথা বালু মহাল ইজারার ক্ষেত্রে। অন্যদিকে নিলামে অংশ নিয়ে শর্ত করার প্রেক্ষিতে নিলাম ও অর্থ বাজেয়াপ্তের শর্ত উল্লেখ থাকলেও তা জেনে শুনেও আমলে নিচ্ছে না উপজেলা প্রশাসন। বারবার বিষয়টি জানানো হলেও নানা কৌশলে পাশ কেটে যাচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এমতাবস্থায় অবৈধ এ বালু উত্তোলনের তার এমন ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন অনেকে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ রানা জানান, নিলামে দেওয়া বালুর পরিমাণ যদি চুক্তিতে উল্লেখিত পরিমাণের চেয়ে কম থাকে সেক্ষেত্রে ক্রয়কৃত বালু অপসারণের পর আবেদন সাপেক্ষে উপযুক্ত স্থান থেকে শুধুমাত্র প্রয়োজনের পরিমাণ বালু উত্তোলনের অনুমোতি দেওয়া কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর আগেই কোথাও হতে বালু উত্তোলন করা যাবে না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের জন্য ডাকা হলে পুলিশ আসে না বলে দায় চাপাচ্ছেন পুলিশের উপর। সীমান্তে বালু উত্তোলন হওয়ায় বিজিবি কেন ব্যবস্থা নেয় না, উল্টো এমন প্রশ্নও ছুঁড়েন তিনি। একপর্যায়ে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে বৃহস্পতিবার অভিযান চালালেও তিনি শুধুমাত্র ব্রিজের আশপাশে ওই অভিযান পরিচালনা করেন। অন্যসব মেশিন বহাল বতিয়তেই রয়ে যায়।
অন্যদিকে ইউএনও’র ভূমিকায় কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল আলম ভুইয়া। তিনি বলেন, নিয়মানুযায়ী পুলিশ চাইলে অবশ্যই দেওয়া হবে। এর আগেও দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আব্দুল্লাহ আল খাইরুম এর কাছে জানতে চাইলে গত বুধবার রাতে তিনি বলেন, কোনভাবেই নিলামে প্রাপ্ত স্টকের বাইরে বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই। এসময় তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেবেন বলেও জানান।