নিজস্ব প্রতিবেদক:
রংপুরের পীরগাছায় ‘তৌহিদি জনতার’ ব্যানারে হেযবুত তওহীদের সদস্যদের বাড়িঘরে কয়েক দফা হামলার ঘটনা ঘটেছে। নৃশংস এই হামলায় বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। হামলায় অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৭ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হামলায় কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে বলে অভিযোগ হেযবুত তওহীদের স্থানীয় সদস্যদের। হামলার মদদদাতা হিসেবে স্থানীয় জামায়াত নেতার নাম উঠে এসেছে। অভিযুক্ত জামায়াত নেতার নাম আলী আহমেদ, তিনি ওয়ার্ড জামায়াতের সাবেক সভাপতি।
সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টার দিকে রংপুরের পীরগাছার ২নং পারুল ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড নাগদহ ছিদাম বাজার সংলগ্ন হেযবুত তওহীদের বিভাগীয় সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস শামীমের বাড়িতে এ হামলার ঘটনা ঘটে।হামলাকারীরা লাঠি, রড, রাম দা, কিরিচসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালায়।
হামলার ঘটনায় আহতদের মধ্যে রয়েছেন- ডা. আজিজ, সুজন আলী, ওবায়দুল হক, মনিরুজ্জামান বাবু, মনির হোসেন, আলমগীর হোসেন, জাফর, ভুট্টু, মুইন উদ্দীন, ইমরান রানা, গফুর আলী, আবিয়াজ রহমান সাগর, এমদাদ, শাহীন, সুজন। আহতরা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
হেযবুত তওহীদের স্থানীয় সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকদিন ধরে একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারা সংগঠনের সদস্যদের ‘হিন্দু’, ‘বিধর্মী’, ‘কাফের’ ইত্যাদি বলে চিহ্নিত করে জনসাধারণকে উসকে দেয়। মসজিদের মাইকে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে লোকজনকে জড়ো করা হয় এবং পরিকল্পিতভাবে হামলার ছক কষা হয়। এ নিয়ে প্রশাসনকে আগেভাগেই অবহিত করা হলেও তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা উগ্রবাদীদের আরও বেপরোয়া করে তোলে বলে অভিযোগ হেযবুত তওহীদ সদস্যদের।
জানা যায়, আব্দুল কুদ্দুস শামীমের বাড়িতে প্রথম দফায় হামলার পর তারা মসজিদের মাইকে মাইকে ঘোষণা দেয়, “নাগদহ ছিদাম বাজার এলাকায় হিন্দুরা মুসলমানদের উপর হামলা করেছে। আপনারা হিন্দুদের প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে আসেন।” এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে তারা হাজারো ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দফায় দফায় হামলা চালাতে থাকে। তারা প্রথমে ৫টি বাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। সংবাদ পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে আসে। কিন্তু আগ্রাসী সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে তারা ব্যর্থ হয়। পরে প্রশাসনের উপস্থিতিতেই ওই বাড়িগুলো এবং বেশ কিছু মোটরসাইকেল আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এসময় পুলিশ ও সেনা-সদস্যরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সকাল ১০টা থেকে শুরু হওয়া এই হামলা বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত চলে। এর মধ্যে কয়েক দফায় লুটপাট, বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে হেযবুত তওহীদের রংপুর বিভাগীয় সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস শামীম বলেন, স্থানীয় জামায়াত নেতার নেতৃত্বে এ হামলা হয়েছে। তাদের পরিকল্পনা জানতে পেরে গতকাল রাতেই জেলা ও উপজেলার জামায়াত নেতাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সকাল থেকে প্রথমে গুজব রটনা করা হয়েছে যে, এখানে যুবলীগ, আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা একত্র হয়েছে। এতে করে জামায়াত শিবিরসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দলের লোকেরা লাঠিসোটা নিয়ে জড়ো হয়। মসজিদের মাইকে প্রচার চালানো হয় যে, হিন্দুরা মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু এলাকার সবাই জানে যে, এ বাড়িটা হিন্দুদের বাড়িও নয়, আওয়ামী লীগের বাড়িও নয়। এটা হেযবুত তওহীদের বিভাগীয় আমির আব্দুল কুদ্দুসের গ্রামের বাড়ি।
তিনি বলেন, তাদের অভিপ্রায় ছিল মূলত হেযবুত তওহীদের সদস্যদের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট করা। তারা একে একে সবগুলো বাড়ি লুটপাট করেছে, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, গোলার ধান সব লুট করে নিয়ে গেছে। সেখানে উপস্থিত হেযবুত তওহীদের সদস্যদেরকে ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা দিয়ে মেরে রক্তাক্ত করেছে। এই কাজগুলো তারা করেছে পুলিশের সামনেই।
হেযবুত তওহীদের এই নেতা বলেন, হেযবুত তওহীদ কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এটা জামায়াত-শিবির ভালোভাবেই জানে। কাজেই হেযবুত তওহীদ জামায়াতের কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়। কিন্তু স্থানীয় জামায়াত শিবিরের কর্মীরা যদি উগ্রবাদী তৃতীয় পক্ষের হাতিয়ারে পরিণত হয় আর এই ধরনের মব সৃষ্টি করে মানুষের বাড়িঘরে হামলা করে, তাহলে আমরা মনে করি, জামায়াত স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেন হেযবুত তওহীদের এই নেতা।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিষয়টিকে অবশ্যই বিবেচনা করবেন। কাউকে তাচ্ছিল্য করা, ছোট মনে করার পরিণতি যে ভয়াবহ তা আওয়ামী লীগের পতনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। হেযবুত তওহীদের রংপুর বিভাগীয় আমির এই নৃশংস হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন দ্রুত হামলাকারীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি তিনি গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরে এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করে হামলাকারীদের আড়াল না করে।
এই হামলার ঘটনার পর পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ জনগণের মধ্যেও নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে হেযবুত তওহীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- এই নৃশংস হামলার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা না হলে তারা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবেন।
পীরগাছা থানার ওসি নুরে আলম সিদ্দিকী জানান, এ ঘটনায় হিযবুত তাওহীদের সাতজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধ কোনো অভিযোগ আাছে কি না? জানতে চাইলে নুরে আলম সিদ্দিকী তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই বলে জানান।