Dhaka Reader
Nationwide Bangla News Portal

ঢাকার আকাশে সামরিক বিমান: শহরের বুকে ঘাঁটি ও বিমানবন্দরের ঝুঁকি কতটা?

রাজধানীর একটি স্কুলের ওপর বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের সাম্প্রতিক ঘটনাটি ঢাকার বুকে বিমানবন্দর ও সামরিক ঘাঁটি থাকার ঝুঁকিকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। এই দুর্ঘটনা একটি পুরনো বিতর্ককে নতুন করে উসকে দিয়েছে- মেগাসিটি ঢাকার মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মাঝখানে বিমানবন্দর ও সামরিক বিমানঘাঁটির সহাবস্থান কতটা যৌক্তিক ও নিরাপদ?

এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর নগরবাসী থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ মহল পর্যন্ত সবাই ক্ষোভ ও উদ্বেগের সাথে প্রশ্ন তুলছেন, জনবহুল এলাকায় সামরিক বিমানের প্রশিক্ষণ বা চলাচল কতটা নিরাপদ?

শহরের বুকে বিমানবন্দর: ঝুঁকি কতটা?
একসময় ঢাকার বিমানবন্দর ছিল তেজগাঁওয়ে। শহরের পরিধি বাড়ায় এবং একটি আধুনিক বিমানবন্দরের চাহিদা থেকে ষাটের দশকে তৎকালীন নির্জন এলাকা কুর্মিটোলায় এটি সরিয়ে আনার কাজ শুরু হয়। ১৯৮০ সালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে এর কার্যক্রম পুরোদমে চালু হলেও কালের পরিক্রমায় সেই নির্জন এলাকাটি আজ রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত ও ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।

বিমানবন্দরের চারপাশে এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য বহুতল আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক স্থাপনা, হোটেল, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ও গার্মেন্টস কারখানা।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদ উল আলম এই পরিস্থিতিকে অত্যন্ত বিপদজনক বলে মনে করছেন। তার মতে, ভবিষ্যতের ঝুঁকি এড়াতে বিমানবন্দরটি সরিয়ে নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, “শহরের মাঝখানে যদি এরকম একটা এয়ারপোর্ট রাখা হয়, তাহলে এটা সবদিক থেকেই আমাদের জন্য বিপদজনক। উদাহরণ হিসেবে ভাবুন, আল্লাহ না করুক, যদি একটি যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক বিমান এখানে বিধ্বস্ত হতো, তাহলে এর পরিণতি কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারতো? বিমানে থাকা যাত্রীদের জীবনহানির পাশাপাশি মাটিতে থাকা হাজারো মানুষের জীবন ও স্থাপনা ধূলিসাৎ হয়ে যেত। বিমানের জ্বালানি বিস্ফোরিত হলে চারপাশের বিশাল একটি এলাকা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। এই বিষয়গুলো আমরা কখনোই গুরুত্বের সাথে চিন্তা করি না।”

একই রানওয়েতে সামরিক-বেসামরিক বিমান: কৌশলগত প্রয়োজন বনাম জননিরাপত্তা
এই ঝুঁকির সাথে যুক্ত হয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একমাত্র রানওয়ে সামরিক ও বেসামরিক উভয় ধরনের বিমানের ব্যবহারের বিষয়টি। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অন্যতম প্রধান ঘাঁটি ‘বিএএফ ঘাঁটি বঙ্গবন্ধু’ এখানেই অবস্থিত হওয়ায় সামরিক বিমানগুলোকে উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য এই রানওয়েই ব্যবহার করতে হয়।

তবে বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী জানান, সামরিক প্রশিক্ষণের মূল এলাকা ঢাকার বাইরে। তিনি বলেন, “ঘাটাইল, টাঙ্গাইল, মধুপুর, শ্রীপুর—অর্থাৎ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও জামালপুর মিলিয়ে আমাদের ডেজিগনেটেড ফ্লাইং ট্রেনিং এরিয়া রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, বিমান এখান থেকে টেকঅফ করে প্রশিক্ষণ এলাকায় চলে যায়। কিন্তু বিমান ঘাঁটি যেহেতু ঢাকায় এবং রানওয়ে একটিই, তাই সামরিক বিমানকে এখান থেকেই উড়তে হয়।”

অন্যদিকে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে বিমানঘাঁটি সরানোর দাবির বিপরীতে বিমানবাহিনী বলছে, কৌশলগত কারণেই ঢাকার এই ঘাঁটির গুরুত্ব অপরিসীম।

সম্প্রতি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন বলেন, “এটি আমাদের প্রধান ঘাঁটি (মেইন বেইস)। দেশের সমস্ত ভিআইপি, সংসদ ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা ঢাকাতেই অবস্থিত। এগুলোর সুরক্ষার জন্য ঢাকায় এমন একটি শক্তিশালী বিমানঘাঁটি থাকা অপরিহার্য। তাছাড়া বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে একটি জায়গা খুঁজে বের করলে তার পাশে আবারও বসতি গড়ে ওঠে। এই দুর্ঘটনা একটি বিরল ঘটনা, এর সঙ্গে ঘনবসতির সম্পর্ক খোঁজাটা ঠিক নয়।”

পুরনো বিমান, নতুন প্রশ্ন
বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি ছিল এফটি-সেভেন (FT-7) মডেলের একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান, যা রাশিয়ার পুরনো মিগ-টোয়েন্টিওয়ান (MiG-21) যুদ্ধবিমানের চীনা সংস্করণ। এই মডেলের উৎপাদন চীনেই বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে প্রশিক্ষণের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এত পুরনো মডেলের বিমান ব্যবহার করা কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।

তবে বিমানবাহিনী প্রধানের মতে, প্রযুক্তি পুরনো হলেও বিমানগুলো পুরনো নয়। তিনি বলেন, “সহজে কোনো বিমান পুরনো হয় না। প্রত্যেকটি বিমানের একটি নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল (লাইফটাইম) থাকে, যা প্রায় ৩০ বছর। মূল বিষয় হলো, এর রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো হচ্ছে কি না। প্রযুক্তিগতভাবে এটি পুরনো হতে পারে, কিন্তু বিমান পুরনো নয়।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা নতুন প্রযুক্তির বিমান আনার চেষ্টা করছি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে নতুন বিমানে দুর্ঘটনা ঘটবে না। উন্নত বিশ্বেও এফ-থার্টি ফাইভের মতো অত্যাধুনিক বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে। আমরা অবশ্যই এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নেব এবং ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি রোধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

এই দুর্ঘটনার পর শোক ও ক্ষোভের পাশাপাশি ঢাকার ভবিষ্যৎ নগর পরিকল্পনা এবং জননিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আবারও সামনে চলে এসেছে, যার যৌক্তিক সমাধান খোঁজা এখন সময়ের দাবি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.