ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি:
ঠাকুরগাঁওয়ের গড়েয়া ইউনিয়নের চণ্ডিপুর গ্রামের বাসিন্দা মুক্তা রাণী রায়, যিনি একসময় সিভিল সার্জন অফিসে আয়া হিসেবে চাকরি করতেন, বর্তমানে শত কোটি টাকার মালিক হিসেবে পরিচিত। স্বামী মারা যাওয়ার পর দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়া মুক্তা রাণী তাঁর চাচাতো ভাই দুলালের মাধ্যমে আয়া পদে চাকরি নেন। সেখানেই তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে ঠাকুরগাঁও-১ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের সঙ্গে। এরপর থেকে মুক্তা রাণীর জীবনে পরিবর্তন আসে এবং তিনি এমপি রমেশ চন্দ্র সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। মুক্তা রাণী পরে নাম পরিবর্তন করে মুক্তা সেন হন এবং তাঁর উত্থান শুরু হয়।
জানা যায়, মুক্তা রাণীর স্বামী কোর্টে মুহুরি হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং তাঁর আয় দিয়ে সংসারে টানাপোড়েন চলত। স্বামী মৃত্যুর পর দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি আয়া পদে চাকরি নিয়েছিলেন। পরে আয়া পদ ছাড়ার পর তিনি ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে যোগ দেন এবং হাসপাতালের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়েন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে মুক্তা সেনের সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট, রেন্ট এ কারের শো-রুম, ঠাকুরগাঁও পৌরশহরের ইসলামবাগে দুই তলা বাড়ি, শান্তিনগরে দুই জায়গায় ৫ শতক করে জমি, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলএসডি গোডাউনের পাশে ১০ শতক জমি, পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের পাশে 3PM নামে একটি রেস্টুরেন্ট, সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বাদুপাড়ায় বাড়ি-জমি ও সয়াবিন তেলের কারখানা, চণ্ডিপুরে বাড়ি, মিল-চাতাল ও পুকুর, এবং ২০ বিঘা আবাদি জমি। এছাড়া, তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার এবং জমি দখল ও নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পত্তি বাড়িয়েছেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, চলতি বছরে মুক্তার দুই ছেলে তূর্য ও মাধুর্য পূবালী ব্যাংক হিসাব নম্বরে ২০ কোটি ৩৮ লাখ ২০ হাজার ৯৯ টাকা লেনদেন করেছে। সাবেক মন্ত্রী ও এমপি রমেশ চন্দ্র সেনের আটক হওয়ার পর দিন মুক্তা রাণী সমস্ত টাকা তুলে নেন। বর্তমানে তাঁর ছেলে তূর্যের অ্যাকাউন্টে ৬ হাজার ৪১৭ টাকা রয়েছে। এছাড়া, জনতা, অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকে গত দুই বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। মুক্তা রাণী তাঁর ভাইদের রাজনীতিতে যুক্ত করে ব্যবসা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লাভবান করেছেন। তার আত্নীয়-স্বজনদের সরকারি চাকরি এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছেন।
মুক্তা রাণীর খালাতো ভাই ফণি রায় বলেন, “সবাই আমাকে মন্ত্রী নাকি আমার ভগ্নিপতি বলে। আমি বলি, বিয়ে তো খেলাম না। মুক্তার পারিবারিক অবস্থা আগে খুব খারাপ ছিল। পরে নিজে বাড়ি কিনেছে এবং অনেক আত্নীয়-স্বজনকে চাকরি দিয়েছে।”
আরেক বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আমরা সবাই তাকে এমপির দ্বিতীয় বউ হিসেবে চিনতাম। এলাকায় জমি, ভাই-বোনসহ আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন। চাকরির বিনিময়ে টাকা নিয়েছে এবং জমিও নিয়েছে। পাশেই মিল-চাতাল পুকুর ২ কোটি ৮ লাখ টাকায় কেনার জন্য ৩০ লাখ অগ্রিম টাকাও দিয়েছিল।”
মুক্তা রাণীর মোবাইলে বারবার কল করা হলেও নাম্বারটি বন্ধ থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন ডা. নুর নেওয়াজ আহমেদ বলেন, “২০১০ সালে মুক্তা রাণী আয়া পদে যোগদান করেন। পরে ২০১৪ সালে তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন।”
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঠাকুরগাঁও সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক তাহসীন মুনাবীল হক বলেন, “আয় বহির্ভূত সম্পদ উপার্জনের কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি এসবের সঙ্গে জড়িত থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”