আওয়ামী সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমে ‘পদলেহন’ সুর বহুগুণ পরিবর্তন পরিলক্ষিত। যেসব মিডিয়া এক সময় আওয়ামী সরকারের পদলেহন করতো, সরকার পতনের পর তাদের ভাষাগত এসেছে পরিবর্তন, বদলেছে সুর। যারা এক সময় হাসিনার গুনগানে ব্যস্ত ছিল, পদলেহনমূলক বাক্যে প্রতিবেদনগুলো বিশেষায়িত করত তারা এখন সুর পাল্টিয়েছে । কোথাও কোথাও সেই সুর গিয়ে ঠেকছে সম্ভাব্য ক্ষমতাধারী দল বা দলের ব্যক্তিদের দিকে।
এইতো ক’দিন আগেও যেসব গণমাধ্যম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধীতামূলক শব্দ ব্যবহার করতো। যারা শেখ হাসিনার পদক্ষেপে প্রশংসায় পঞ্চমূখ ছিল তারাও আজ শেখ হাসিনার বিরোধিতা শুরু করেছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের আগে যেসব পত্রিকা, সাংবাদিক ও তাদের শীর্ষ কর্তারা হাসিনা ও তার সরকারের পদলেহনে ব্যস্ত থাকতো, যাদের মুখে শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচার বলা তো দূর, তার বিরুদ্ধে দুটি লাইন লেখার প্রয়োজন মনে করতো না তারাও এখন শেখ হাসিনা বিরোধী মনোভাব দেখাচ্ছে। ফলাও করে ছাপাচ্ছে “রক্তসমুদ্রে স্বৈরাচারের পতন”।
১৫ আগস্টই বলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে যারা আর্টিকেলের বন্যা বইয়ে দিত, আওয়ামী সরকারের পতনের পর তাদের পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে সাদামাটা একটা নিউজ ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ হয় নি। আর একই দিন খালেদা জিয়ারও জন্মদিন পালন করে থাকে বিএনপি; শেখ হাসিনার পতনের আগে এই বিষয় নিয়ে কোনো আর্টিকেলতো দূর, সংবাদও প্রকাশ হতো না যেসব পত্রিকায় হাসিনার পতনের পর তারা এখন খালেদা জিয়ার একপ্রকার গুণগান করেই আর্টিকেল প্রকাশ শুরু করেছে। ‘দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেত্রী, অবিসংবাদিত নেত্রী’ ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষণে ভরিয়ে দিচ্ছেন তাদের আর্টিকেলগুলো।
ক্ষমতা ছাড়ার কদিন আগে সাংবাদিকদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; যার আয়োজন করে এডিটরস গিল্ড নামের একটি সংগঠন। সেই সম্মেলনে দেশের শীর্ষস্থানীয় মিডিয়াগুলোর শীর্ষ কর্তারা উপস্থিত ছিলেন। একদিকে যখন দেশে গণহত্যা চলছিল সেই বিষয় নিয়ে কথা না বলে পদলেহনকারী সাংবাদিকরা আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এঁদের কেউ কেউ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনার ওপর জোর দেন। আর এক সাংবাদিক তো ‘তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাঁদের আস্থা ও বিশ্বাস থাকায় তাঁর জন্য যা প্রয়োজন তা করতে পারেন।” বলেন। তবে হ্য এই পা চাটা সাংবাদিকদের অনেকেই ইতোমধ্যে আওয়ামী সরকারের বিরোধিতার সুর তুলেছেন বা কেউ কেউ সুর তোলার জন্য রাস্তা খুঁজছেন।
মোটকথা সাংবাদিকতা তার মূল তত্ত্ব থেকে সরে গেছে। অধিকাংশ সাংবাদিকরা এখন ক্ষমতার পদলেহনে ব্যস্ত থাকে। ফলে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পেশাগত ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সাংবাদিকরা এখন পেশাগত প্রতিশ্রুতির জায়গায় নেই। পেশাগত দায়িত্ব (প্রফেশনালিজম), সৎ, নির্ভীক, সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা এখন নেই বললেই চলে। সাংবাদিকদের কাছে আদর্শের চেয়ে ভোগবাদিতাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে গণমাধ্যমগুলো যেন কর্পোরেট আগ্রাসনের শিকার হয়ে মূল ধারা থাকে বহুদূরে চলে গিয়েছে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পতনের পর বিশেষ করে পত্রিকা সংশ্লিষ্টরা ধরেই নিয়েছে আগামী সরকার বিএনপি গঠন করবে। ফলে এখন শুরু হয়েছে বিএনপি ও এই দলের নেতাদের পদলেহন। গোড়া পর্যায়ে সাংবাদিক থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের সাংবাদিকরা অদূর ভবিষ্যতে যদি বিএনপি ক্ষমতায় যায় তবে তাদের পদলেহন শুরু করবে। সাংবাদিকতা বলে যে বস্তুনিষ্ঠতা, সততা, ছিল তারও আর বালাই রইলো বললেই চলে।
লেখক: নিহান, সাধারণ নাগরিক।