বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক পরিষদ বাসাপ’র উদ্যোগে কিংবদন্তী কবি, গীতিকার ও গবেষক অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী স্মরণে তার জীবন ও কর্ম মূল্যায়নে এক আলোচন সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রবিবার বিকাল ৫টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্রে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক পরিষদের সভাপতি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব পীরজাদা শহীদুল হারুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লি. এর চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ।
অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন হেযবুত তওহীদের চেয়ারম্যান এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। তিনি তার মূল্যবান বক্তব্যে বলেন, অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরীর জীবনের অনেকটা জুড়ে ছিল গান। কেবল তার গানের দিকে তাকালেই বোঝা যায় তিনি কেমন মানুষ ছিলেন। আপনারা জানেন যে, ১৯৪৮ সালে মহান বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান ‘ওরে ভাইরে ভাই বাংলাদেশে বাঙ্গালী আর নাই’ তার লেখা গান। আমাদের লাল সবুজের পতাকা নিয়ে প্রথম গান ‘সবুজ মাটিতে শহিদী রক্ত মাখা’ তার কলম বেয়েই নেমেছিল। এছাড়াও প্রথম পহেলা বৈশাখের গান ‘ওগো বৈশাখী ঝড়’। যুগ যুগ ধরে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষ ছড়াচ্ছে ধর্মব্যবসায়ীরা তার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন এই গুণী গীতিকাল। তিনি লিখেছেন- ‘হিংসায় গড়া আজিকার ধরা ভরা শুধু হাহাকার’ যা ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রথম গান। তার লেখা আরেকটি বহুল প্রচারিত উল্লেখযোগ্য গান ‘রূপালী নদীরে রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল’ গানটি শুনলে আমি উদাস হয়ে যাই। ওনার গান শুনলেই বোঝা যায় সারাজীবন তিনি বাঙ্গালি, বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাংলার মানুষ, বাংলার মানুষের মুক্তি সংগ্রামের মন্ত্র ছিল তার রচনার পরতে পরতে।
তিনি বলেন, গণমানুষের সংগ্রামের পুরোধা ছিলেন আনিসুল হক চৌধুরী। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামসহ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণা যুগিয়েছেন কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার ও শিল্পীরা। তাদের মধ্যে আনিসুল হক চৌধুরী ছিলেন অন্যতম।
তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। সেই ইতিহাসের সূচনা হয়েছে বহু বছর আগে। আমাদের দেশ সুলতানী যুগের দুইশ বছর স্বাধীন ছিল। বৃহত্তর বঙ্গের রাজধানী ছিল গৌড়। গৌড়ের সিংহাসনের শেষ স্বাধীন সুলতান ছিলেন দাউদ খান কররানি। সম্রাট আকবর বাংলাদেশকে দিল্লীর পদানতা করতে সেনাবাহিনী পাঠান। ১৫৭৬ সনে রাজমহলে মোকাবেলা হয়। এই কররানি পরিবারের উত্তরসূরীরাই টাঙ্গাইলের পন্নী জমিদার পরিবার। মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী এই পরিবারের সন্তান। তিনি ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে তেহরিক-ই খাকসার আন্দোলনের পূর্ব বাংলার কমান্ডার ছিলেন। তিনি আইন পরিষদের কণিষ্ঠতম পার্লামেন্টেরিয়ান ছিলেন। নজরুল একাডেমির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিনি সারাজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছেন। যাই হোক, এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাঙালির সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এসেছে একাত্তর সাল। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো। দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি। এখন আমাদের সামনে কী সংকট? ভাবতে হবে। বুঝতে হবে।
তিনি বলেন, এখন আমাদের মূল সংকট হচ্ছে- রাজনৈতিক সংকট, ধর্মের অপব্যবহার করে গুজব, হুজুগ, জঙ্গিবাদ, উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতার সংকট। আওয়ামী লীগের নেতারা ভাবছেন ক্ষমতায় বিএনপি গেলে একদিনে আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ কর্মীকে হত্যা করা হবে। মনে রাখতে হবে ধর্ম ১ নাম্বার ইস্যু। সাংস্কৃতিক অঙ্গন নিয়ে কথা বলবেন? এখানেও সেই ধর্মের নামে ফতোয়াবাজি। এ বিষয়ে আমরা হেযবুত তওহীদ ধর্মের দৃষ্টিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও শিল্পচর্চা নিয়ে সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছি।
সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র যদি হারামই হতো তাহলে পবিত্র কোর’আনে কি আল্লাহ একটি আয়াতেও কি আল্লাহ সেটা উল্লেখ করতে পারতেন না? না। তিনি কোথাও এ জাতীয় কোনো কথাই বলেন নি। কিন্তু দীনের অতিবিশ্লেষণ করে সুরা লোকমানের ৬ নম্বর আয়াতকে সঙ্গীতের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয় যেখানে আল্লাহ সঙ্গীত শব্দটিই বলেন নি, বলেছেন অসার কথাবার্তা। আল্লাহ বলেন, “একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।”
আল্লাহ কোরানে বলেছেন- “আপনি বলে দিন: আমার পালনকর্তা কেবলমাত্র অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য, হারাম করেছেন আল্লাহর নাফরমানি, অন্যায়-অত্যাচার চালানো, আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, তিনি যার কোনো সনদ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জানো না (সুরা আরাফ ৩৩)।
রসুলাল্লাহর উপস্থিতিতেও মদীনায় সাহাবীদের বিয়ে শাদি বা অন্য যে কোনো উৎসবে দফ বাজিয়ে গান গাওয়া হতো। আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘তোমরা এই বিবাহের ঘোষণা দাও। এটা মসজিদে সম্পন্ন করো এবং বিবাহ উপলক্ষে দফ বাজাও।’ একটি হাদিসে এমন কি এও বলা হয়েছে যে, ‘হালাল ও হারামের মাঝে পার্থক্য নির্ণয়কারী হলো- বিয়ের সময় দফ বাজানো এবং তা জনসম্মুখে প্রচার করা।’ সুতরাং বিয়েতে গান-বাজনা করা রসুলাল্লাহর হুকুম।
জাহেলিয়াতের যুগে আরবে গান আর অশ্লীলতা ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই অনেক সাহাবি গানকেই ফাহেশা কাজ বা মন্দ কাজ বলে ভাবতে লাগলেন। কিন্তু রসুলাল্লাহ (সা.) তাঁদের এই ভুল ধারণা ভাঙিয়ে দিলেন। আম্মা আয়েশা (রা.) খুব সংগীতানুরাগী ছিলেন। তাঁর গৃহে রাসুলাল্লাহর (সা.) উপস্থিতিতেই সংগীত চর্চার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
সবশেষে হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম বলেন, গানের মাধ্যমে বিপ্লব, স্বাধিকার অর্জন, সংগ্রাম ও দেশপ্রেম সৃষ্টির চেতনাÑ আমি মনে করি, গানের সর্বোত্তম ব্যবহার এটাই। এবং মানুষের কল্যানে, জাতির কল্যানে, মানবাধিকার রক্ষায়, উগ্রতা, অপরাজনিতি, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে গান, কবিতা, অভিনয় হারাম নয় বরং জেহাদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম বলেন, হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমকের বক্তব্য শুনে নিজেকে খুবই ক্ষুদ্রই মনে হচ্ছে। এরকম যৌক্তিক আলোচনা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আনিসুল হক চৌধুরী সম্বন্ধে আমি খুব বেশি জানি না। তবে তার সম্বন্ধে যতটুকু জেনেছি, তার গান, কবিতা, সাহিত্য ছিল বাংলার মাণুষের জন্য, বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য। তিনি অনুষ্ঠানের আয়োজক ‘বাসাপ’ কে ধন্যবাদ জানান এমন একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধক বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লি. এর চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ প্রথমেই প্রধান আলোচকের বক্তব্যের ভূয়ষী প্রসংসা করে বলেন, সেলিম ভাইদের মতো সংগ্রামী চরিত্রের লোক যারা সত্য প্রকাশে নির্ভিক, ওনাদের মতো লোকই আমাদের শক্তি যোগায়, সাহস যোগায়। ওনার মত লোককে আমরা পাশে পেয়ে ধন্য। আমরা সবসময়ে ওনাকে সাথে নিয়ে চলতে চাই।
অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরীর কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সাহিত্যাঙ্গনের একজন মহীরুহ ছিলেন, বটগাছ কে আমরা ভুলে গেলাম এটা লজ্জার। বাংলাদেশের জন্মের কালে তিনি গীতিকার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। বাংলার গণ সঙ্গীতের জনক বলা চলে। ওনার গানের বিস্তৃতি ব্যাপক। সব অঙ্গনে তার পদচারণা ছিল। ওনার রচনা দেখলেই বোঝা যায়, সমাজকে পরিবর্তনের জন্য, মানবতার জন্য কাজ করেছেন তিনি।
সবশেষে তিনি বলেন, প্রচারবিমুখ একজন লোক ছিলেন অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী। তাই অনেকে ওনাকে জানেন না, চেনেন না। তিনি টাকার পেছনেও ছোটেননি। তিনি ছিলেন আননোন হিরো। এরকম হিরোকে আমাদের জানতে হবে চিনতে হবে। ওনাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে।
সাধারণ সম্পাদক আলী আশরাফ আখন্দ এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন- কলাবাগান থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৬ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বাবুল, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এএসএম নাজীবুল আকবর, এটিএন বাংলা উপদেষ্টা তাশিক আহমেদ, দৈনিক আমাদের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক মিয়াজী সেলিম আহমেদ, বিশিষ্ট সমাজ সেবক হাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরীর জীবন ও কীর্তির উপর নির্মিত একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানটির যৌথ উপস্থাপনায় ছিলেন মঞ্জুর হোসেন ইশা ও শিমুল পারভীন। অনুষ্ঠানের মিডিয়া পার্টনার ছিলো অগ্রণী বার্তা। অনুষ্ঠান শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।