ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দোল্লাহিয়ানকে বহনকারী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার খবর প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা ধরে তাদের মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশিত হচ্ছিল। কিন্তু অবশেষে সোমবার কর্তৃপক্ষ তাদের নিহতের কথা নিশ্চিত করেছে।
দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট নিহত হবেন, এমন দেশ হিসেবে ইরানকে বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু দেশটিতে নিয়মিত বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকায় দুর্বল অবকাঠামোকে এ জন্য দায়ী করা হয়।
অতীতের বছরগুলোতে একই ধরনের দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন মন্ত্রিসভার অন্তত দুজন সদস্য ও দুই শীর্ষ সামরিক কমান্ডার। রাইসি ও তার সঙ্গীদের বহনকারী হেলিকপ্টারটি কুয়াশা ও পাহাড়ি জনপদ হিসেবে পরিচিত উত্তরপশ্চিম ইরানের আকাশে ছিল। এই ‘ঘটনাটি’ হয়ত নিছক একটি দুর্ঘটনা হতে পারে।
তবে এই বিধ্বস্তের ঘটনাটি ঘিরে সন্দেহ থাকবে অনিবার্যভাবে। যেসব বিমান দুর্ঘটনায় সিনিয়র রাজনৈতিক নেতা নিহত হয়েছেন সেগুলো নিয়ে এখনও সন্দেহ উঠে আসে। যেমন- নর্দার্ন রোডেশিয়া (১৯৬১), চীন (১৯৭১), পাকিস্তান (১৯৮৮) ও পোল্যান্ড (২০১০)-এর দুর্ঘটনা। এমন ক্ষেত্রে অতীতের ঘটনাগুলোর মতো জল্পনায় রসদ জোগায় একটি প্রশ্ন: রাইসির মৃত্যুতে রাজনৈতিকভাবে কে লাভবান হবে? যদিও এই প্রশ্নের জবাব নিশ্চিতভাবে জানাবে না যে, হেলিকপ্টারটি কেন বিধ্বস্ত হয়েছিল। তবে এই প্রশ্নের জবাব ইরানে আগামীতে কী ঘটবে তার ওপর আলোকপাত করতে পারে।
২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন রাইসি। ১৯৯৭ সালের পর দেশটিতে সবচেয়ে কম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন ছিল তা। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি নিশ্চিত করেছিলেন যাতে করে কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী যেনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারেন। যাদেরকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে তাদের মধ্যে শুধু যে সংস্কারপন্থিরা ছিলেন তা নয়, ছিলেন মধ্যপন্থি রক্ষণশীলরাও। এমনকি কট্টরপন্থি সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেতাজাদও ছিলেন- যাকে খামেনি নিজের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করেন।
রাইসিকে খুব ভেবেচিন্তে মনোনীত করা হয়েছে। কারণ তিনি কখনও খামেনির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন না বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে বিতর্কে নিজের কোনও ক্যারিশমা দেখাতে পারেননি তিনি। ২০২১ সাল থেকে দায়িত্ব পালনকালে শুধু যে অদক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন তা নয়, রাজনৈতিকভাবে তিনি যে চৌকস নন, তাও তুলে ধরেছেন। অনেকে তাকে অদৃশ্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ২০২২-২৩ সালের নারীদের আন্দোলনের সময় বিক্ষোভকারীরা তার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে সময় ও শ্রম নষ্ট করতে চাননি। কারণ তারা জানতেন, প্রকৃত ক্ষমতাধর অন্য কেউ।
খামেনির কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাইসি তাদের দেখানো পথে থাকবেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে তার খুব বেশি প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। ইরানের জীবিত সাবেক কর্মকর্তাদের মধ্যে হয়ত রাইসির হাতে বেশি মানুষের রক্ত লেগে আছে।
১৯৮০ দশকের পর থেকে হাজার হাজার ভিন্নমতালম্বীকে ফাঁসি দিয়েছে ইরান। এই হত্যাযজ্ঞ কার্যকর করতে সরকারের হয়ে কাজ করেছে বিচার বিভাগ। শুরু থেকেই এর নেতৃস্থানীয় অবস্থানে ছিলেন রাইসি। ২০১৯ সালে বিচার বিভাগের প্রধান হন তিনি। এই ভূমিকার জন্য তাকে ‘তেহরানের কসাই’ আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
এই দক্ষতার কারণেই ধর্মীয় শাসকগোষ্ঠীর কাছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সবচেয়ে নিরাপদ পছন্দ ছিলেন রাইসি। যা তাকে সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে খামেনির একজন সম্ভাব্য উত্তরসূরিতেও পরিণত করেছিল। ইরানের সংবিধান অনুসারে, শুধু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থাকা ধর্মীয় নেতা রাষ্ট্রের প্রধান হতে পারবেন।
এই যোগ্যতা থাকা বেশিরভাগ ধর্মীয় নেতা মারা গেছেন অথবা রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন (অনেকে খামেনির কট্টরপন্থি রাজনীতি পছন্দ করেন না), এর ফলে রাইসির জন্য মাঠ ছিল ফাঁকা। অপর দিকে, অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করতেন, রাইসি একজন দুর্বল সর্বোচ্চ নেতা হতেন। এতে করে ক্ষমতার মূল ভরকেন্দ্র অন্যত্র চলে যেত। যেমন- ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) বা ক্ষমতার অন্য কেন্দ্রগুলোতে।
এমন দায়িত্ব নিতে কে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছেন?
ইরানের অভিজাত রাজনৈতিক শ্রেণির এক বিশেষ অংশ থেকে এসেছেন রাইসি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাকে ঘিরে থাকা মানুষদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে অপর রাজনৈতিক শ্রেণিগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশাদের পবিত্র মাজারের জামিনদার ছিলেন তিনি। এটি নিজেই একটি অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য। মাশাদের জুমার নামাজের ইমামের মেয়েকে বিয়ে করেছেন রাইসি।
রাইসির স্ত্রী জামিলেহ আলামোলহোদা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ্য ভূমিকা পালন করেছেন। নিজেদের রাজনৈতিক শ্রেণির বাইরের রক্ষণশীলদের নিজেদের বলয়ে নিয়ে এসেছেন। এই রক্ষণশীলদের আশঙ্কা ছিল, খামেনির মৃত্যুর পর মাশহাদ গোষ্ঠী ক্ষমতায় চলে আসতে পারে।
রাইসির আপাত নিষ্ক্রিয়তার ফলে কট্টরপন্থিদের মধ্য থেকে তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো প্রস্তুতি ছিল। এই কট্টরপন্থিরা দুর্বল প্রেসিডেন্সিকে নিজেদের রাজনৈতিক উত্থানের সুযোগ হিসেবে দেখেছিল। এদের একজন হলে পার্লামেন্টের স্পিকার মোহাম্মদ বাকে কালিবাফ। চলতি বছরের শুরুতে পার্লামেন্টারি নির্বাচনে এসব কট্টরপন্থিদের অনেক ভালো ভোট পেয়েছে। যদিও এই লড়াই ছিল মূলত কট্টরপন্থিদের ভেতরেই। রক্ষণশীল প্রধান রাজনৈতিক দল ও আইআরজিসির অনেক শাখার সমর্থন রয়েছে কালিবাফের প্রতি।
এসব কারণে রাইসির মৃত্যু ইরানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে দিতে পারে। ইরানের সংবিধান অনুসারে, প্রথম ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। মোখবার, কালিবাফ ও প্রধান বিচারপতি ঘোলা হোসেইন মোহসেনির সমন্বয়ে গঠিত একটি কাউন্সিল ৫০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করবে।
রাইসির মৃত্যুর রাজনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে এক ইরানি কর্মকর্তা বলেছেন, কালিবাফ হবেন নতুন প্রেসিডেন্ট।
রাইসির মৃত্যুতে লাভ কার?
কালিবাফের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেকের কাছে নতুন কোনও খবর নয়। ২০০৫ সাল থেকে বেশ কয়েকবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তিনি। তিনি আদর্শবাদীর চেয়ে টেকনোক্র্যাট বেশি। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় আইআরজিসির একজন কমান্ডার ছিলেন তিনি। ফলে বাহিনীটিতে তার প্রতি সমর্থন থাকতে পারে। ২০০৫-২০১৭ সাল পর্যন্ত তেহরানের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অদক্ষতা ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। কালিবাফের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা সম্প্রতি তার ও তার পরিবারের একটি দুর্নীতির কথা প্রকাশ্যে আনছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট রুহানির এক ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, কালিবাফের সমস্যা হলো তিনি অনেক বেশি চান। সবাই জানে যে, তার কোনও নীতি নেই এবং ক্ষমতার জন্য যেকোনও কিছু করবেন তিনি।
তাড়াহুড়ো করে আয়োজিত নির্বাচনে কালিবাফ যদি প্রার্থী হন তাহলে গার্ড কাউন্সিলের পক্ষ থেকে তাকে প্রত্যাখ্যান করা কঠিন হতে পারে। বিশেষ করে ইরানের ক্ষমতা কাঠামোতে তার গভীর সম্পর্কের কারণে। কিন্তু পর্যাপ্ত ইসলামি ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ জ্ঞান না থাকা একজন টেকনোক্র্যাটের কাছে ক্ষমতা তুলে দেওয়াতে কি খুশি হবেন খামেনি? যদি না হন তাহলে কালিবাফকে নির্বাচনে হারাতে প্রার্থী হওয়ার অনুমতি পাবেন কারা, যেমনটি আহমদেনিজাদ ও রুহানি যথাক্রমে ২০০৫ ও ২০১৩ সালে হেরেছিলেন।
এমন ক্ষেত্রেও একটা জটিলতার সুযোগ রয়েছে। কালিবাফকে সমর্থনকারী অনেক সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা আবার খামেনির উত্তরসূরি হিসেবে ছেলে মোজতবার পক্ষে ওকালতি করছেন। দীর্ঘদিন ধরে আড়ালে রয়েছে মোজতবা খামেনি। ৫৪ বছর বয়সী মোজতবার রাজনীতি বা দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। তবে তাকে ভবিষ্যতের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী মনে করেন অনেকে।
এক্ষেত্রে মোজতবা ও কালিবাফের মধ্যে কোনও সমঝোতা হয়ত পারে উভয়ের ক্ষমতার পথ খুলে দিতে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকারী নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যু হয় ১৯৮৯ সালে। ধর্মীয় নেতা আকবর হাশেমি রাফসানজানির সঙ্গে অলিখিত চুক্তির পর সর্বোচ্চ নেতা হয়েছিলেন খামেনি। ওই সময় রাফসানজানি ইরানের প্রেসিডেন্ট হন। প্রেসিডেন্টকে আরও ক্ষমতা দিতে দ্রুত সংবিধান সংশোধন করা হয়। কিন্তু পরে যখন মৃত্যুর আগে রাজনৈতিকভাবে দূরে ঠেলে দেওয়া তখন অনুশোচনায় ভুগছিলেন রাফসানজানি। ২০১৭ সালে তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে অনেক ইরানির সংশয় রয়েছে।
অনেকেই ইরানে ক্ষমতার লড়াইয়ের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। তবে তারা বলেছিলেন খামেনির মৃত্যুর পর তা শুরু হতে পারে।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেই লড়াইয়ের একটি ড্রেস রিহার্সেল এবার হয়ে যেতে পারে। যে লড়াইয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে উন্মুখ থাকবে। ইরানের জনগণের মধ্যে অনেকেই রাইসির মৃত্যু উদযাপন করতে শুরু করেছেন। তেহরানে আতশবাজি পোড়ানোর খবরও পাওয়া গেছে।
বেশিরভাগ ইরানিরা মনে করেন ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কোনও দলই তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। কেউ কেউ রাজনৈতিক সংকটের একটি মুহূর্ত ব্যবহার করতে পারে রাজপথের প্রতিবাদকে পুনরুজ্জীবিত করতে। যা অতীতে বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধেও হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলমান বিক্ষোভে দেশটির বিরোধীরা প্রায় ক্লান্ত বলা চলে। সম্প্রতি সময়, ২০২২ থেকে ২০২৩ সাল বিক্ষোভে পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। ক্ষমতার চূড়ায় পৌঁছার লড়াই যে রূপ ধারণ করুক না কেন, ইরানের জনগণ বেশিদিন তা নিষ্ক্রিয়ভাবে মেনে নেবে না।