গণঅভ্যুত্থানের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েও পাঁচ মাস পেরিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন বা নীতি স্পষ্ট নয়। বরং তাদের কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দুতে বারবার উঠে আসছে তীব্র আওয়ামী লীগ বিরোধিতা, যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা। একইসাথে, দলীয় কর্মসূচি পালনে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার ঘটনাও জন্ম দিয়েছে নতুন বিতর্কের।
প্রশ্ন উঠছে, দলটি কি নিছক আওয়ামী লীগ বিরোধিতাকে পুঁজি করেই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়তে চাইছে? এনসিপি নেতারা এমন অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দিলেও বিশ্লেষকরা তাদের কথা ও কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক খুঁজে পাচ্ছেন। তারা বলছেন, এই নেতিবাচক রাজনীতির ধারা দলটির জন্য ‘হিতে বিপরীত’ হতে পারে।
উস্কানিমূলক কর্মসূচি ও ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ’ স্লোগান
এনসিপির আওয়ামী লীগ-কেন্দ্রিক রাজনীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ ছিল তাদের ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি। দেশব্যাপী পদযাত্রার অংশ হলেও শুধু গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রেই কর্মসূচির এমন নামকরণ করা হয়, যা শুরু থেকেই উত্তেজনা ছড়ায়।
কর্মসূচির আগের দিন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ফেসবুকে লেখেন, “আগামীকাল গোপালগঞ্জে স্লোগান হবে- মুজিববাদ মুর্দাবাদ”। পরদিন উত্তেজনার মধ্যেই তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে একই স্লোগান দেন। এমনকি দলটির শ্রমিক উইংয়ের এক নেতা ফেসবুকে “মৃত্যু অথবা মুজিব মাজার ভাঙা”র মতো উস্কানিমূলক পোস্টও দেন।
যদিও এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব এগুলোকে “ব্যক্তিগত বক্তব্য” বলে দাবি করেছেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ফরিদপুরের কর্মসূচিতেও দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একই স্লোগান দেন। এর আগে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাও এবং ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাকে সমর্থন করার মতো কর্মকাণ্ডেও এনসিপি নেতাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল।
এনসিপির আত্মপক্ষ সমর্থন: ‘বিদ্বেষ নয়, বিচার চাই’
আওয়ামী লীগ বিরোধিতাকে পুঁজি করার অভিযোগের জবাবে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “নিছক আওয়ামী বিরোধিতা বা আওয়ামী লীগের কাউন্টার করাকে আমরা প্রয়োজনীয় রাজনীতি মনে করি না। বরং আওয়ামী লীগের বিচার হওয়াটাকেই আমরা আমাদের বর্তমান কর্মসূচির অংশ মনে করি।”
দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীবও একই সুরে বলেন, “গত ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিবাদ হিসেবে আওয়ামী লীগ যে গুম, খুন, হত্যা ও দমন-পীড়ন করেছে, সেগুলোর বিচার চাইতে গেলে বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ চলে আসে।” তাদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হিসেবে তারা দেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন।
বিশ্লেষকদের চোখে ‘দৃষ্টিভঙ্গিহীন রাজনীতি’
তবে দলটির নেতাদের এসব যুক্তিকে অপর্যাপ্ত মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, একটি রাজনৈতিক দলের জাতীয় স্বার্থে যে ধরনের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকা দরকার, তার বদলে এনসিপির সব কর্মকাণ্ডই আওয়ামী লীগ বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, “রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা এখনো এমন কোনো বক্তব্য নিয়ে আসতে পারেনি, যা দিয়ে মানুষ আশাবাদী হতে পারে। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি বা সমাজনীতি নিয়ে তাদের কোনো পরিষ্কার বক্তব্য নেই। তারা কেবল ফ্যাসিস্টবিরোধিতা আর আওয়ামী লীগ বিরোধিতার মধ্যেই নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধার মতে, এনসিপি সংস্কারের কথা বললেও তাদের মনোযোগ একটি জায়গাতেই আটকে আছে। তিনি বলেন, “তাদের পুরো মনোযোগ রাষ্ট্রগঠনের দিকে না হয়ে বারবার কিছু উপড়ে ফেলা, কিছু ভেঙে ফেলার দিকে- কখনো ৩২ নম্বর, কখনো মুজিববাদ।”
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় কর্মসূচি: জনসংযোগ নাকি অদূরদর্শিতা?
এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে আরেকটি বড় বিতর্ক হলো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নজিরবিহীন নিরাপত্তা। গোপালগঞ্জে উত্তেজনার খবর জেনেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তাবেষ্টনীতে তারা সেখানে প্রবেশ করে এবং হামলার মুখে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে করে এলাকা ছাড়ে। একই চিত্র দেখা গেছে ফরিদপুর এবং কক্সবাজারেও।
এই প্রসঙ্গে রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, “রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে সাথে নিয়ে জনসংযোগ হয় না। জনসংযোগ হয় মানুষের মনের গভীরে পৌঁছাতে পারলে। কিন্তু আমি যদি এমন এজেন্ডা নিয়ে যাই, যেখানে বিশৃঙ্খলাকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে, তবে সেটা স্রেফ রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা।”
অবশ্য এনসিপি নেতাদের দাবি, জীবনের ঝুঁকি থাকায় তারা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিতে বাধ্য হয়েছেন।
ভবিষ্যৎ পথচলা: হিতে বিপরীত হওয়ার ঝুঁকি
গোপালগঞ্জে সহিংসতা সত্ত্বেও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম পুনরায় সেখানে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, “এবার আমরা ফিরে আসার জন্য মার্চ করবো না। গোপালগঞ্জের মাটি ও জনগণকে মুজিববাদ থেকে চিরতরে মুক্ত করে ফিরে আসবো।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের বক্তব্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ঘাটতিকেই প্রকাশ করে। তাদের মতে, একটি মতাদর্শকে সরাতে হয় নতুন এবং উন্নত কোনো রাজনৈতিক দর্শন দিয়ে, যা এনসিপি এখনো সামনে আনতে পারেনি।
অধ্যাপক সাব্বির আহমেদের মতে, কেবল অন্য দলের বিরোধী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা সহিংসতাকে উস্কে দেবে এবং দল হিসেবেও তারা বেশি দূর এগোতে পারবে না। তার কথায়, এই পথচলা “এনসিপির জন্য হিতে বিপরীত হবে।” -বিবিসি বাংলা