“শেখ হাসিনাকে হয়ত এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হতো না। তিনি হয়ত আবারও ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। কিন্তু কোটা ইস্যুতে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা শেখ হাসিনাকে খেয়েই দিল। দেশ ছেড়ে পালাতে হলো শেখ হাসিনাকে।” গতকাল রাজধানীর উত্তরার জসিম উদ্দিনে শেখ হাসিনার ভারত পলায়ন, আওয়ামী সরকারের পতন ও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপকালে এ কথা বলেন ওবায়দুল হোসাইন নামে এক ব্যাক্তি।
তিনি বলছিলেন, শেখ হাসিনা ও তার সরকার সবসময় মুক্তিযোদ্ধাদের বেশি বেশি সুবিধা দিতে চাইতো। মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবার, নাতিপুতিদেরও ভাতা দিয়েছে। সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রী-সন্তানদের ঘর করে দিচ্ছে। কিন্তু কোটায় গিয়ে শেখ হাসিনা কট খাইলো।
পঞ্চাশোর্ধ্ব ওবায়দুল হোসাইন বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় একেবারেই ছোট ছিলাম, মায়ের কোলে। মুক্তিযুদ্ধের কোনো কিছুই দেখি নাই। তবে শেখ হাসিনার মুক্তিযোদ্ধাপ্রীতি মোটেও খারাপ না। যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তারা অবশ্যই দেশের থেকে কিছু প্রাপ্য। কিন্তু তাদের নাতিপুতিদের কোটা দিয়ে চাকরি দেওয়া দেশের স্বাধীনতার সাথে উপহাস করার মতো।
“শেখ হাসিনা শুধু মুক্তিযোদ্ধা, তাদের নাতিপুতিদের দিকেই দেখেছে, তাদের প্রাধান্য দিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা মারা গেছে, শহীদ হয়েছে; তাদের দিকেও দেখা উচিৎ ছিল। কেননা যারা শহীদ হয়েছে তাদের সন্তানদের পরবর্তীতে অনেক যুদ্ধ করে বড় হতে হয়েছে। তাদের অধিকাংশই জীবনে কিছু করতে পারেনি। তাদের সন্তানদেরও দেখা উচিৎ ছিল।” বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। তার পিতাও যুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের হাতে মারা গেছেন বলেও জানান তিনি।
তবে দেশে বর্তমান মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অধিকাংশ ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে বলে তিনি জানেন বলেও জানান তিনি। তার নিজ এলাকা রংপুর এবং লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নরসিংদীতে বসবাস করা অবস্থায় অনেকে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লিখিয়েছেন বলেও উল্লেখ করে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এ সময় কথা না থামিয়ে ভাতা, বাড়ি-ঘর বানিয়ে দেওয়ার পরও কেন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-নাতিপুতিদের কোটার নাম দিয়ে চাকরি দেওয়া হতো সে বিষয়েও নিজের মতামত জানান এই ব্যক্তি। তার ভাষ্য, আজকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শতশত কর্মকর্তা পালিয়েছে, পদত্যাগ করছে। এরা কারা? এরাই তো তারা যাদের শেখ হাসিনা কোটার নামে সরকারি চাকরি দিয়েছে। এরাই তারা যারা কিনা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় থাকার কোর হিসেবে কাজ করেছে। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও এরা সাপোর্ট দিয়ে তাকেপাতানো নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে সর্বত সহায়তা করেছে । তাদের গোড়ায় গিয়ে দেখেন তারা কোটাতেই নিয়োগ পেয়েছে।
তবে কোনো অত্যাচারই, স্বৈরাচারির ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী নয় বলেও দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। তবে শেখ হাসিনা তার স্বৈরাচারিতার মাধ্যমের নিজেও যেমন অপমান করেছে তেমনি তার জন্যই তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুবিজের অপমনা করেছে। শেখ মুজিবের অপমানের জন্য একমাত্র শেখ হাসিনা ও তার চামচারা দায়ী। শেখ হাসিনার জেদ, দম্ভ তাকে শেষ করে দিয়েছে। সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগেরও বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর ছাত্রদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন করপোরেশনে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি সংশোধন করে পরিপত্র জারি করে। ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চের স্মারক সংশোধন করে জারি করা পরিপত্রের ভাষ্য, ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধারভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে এবং ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি বাতিল করা হয়।
ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে ওই পরিপত্র কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে রায় দেওয়া হয়।
২০২৪ সালের ৫ জুন নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলসংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। মুক্তিযোদ্ধা সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজনের করা ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। ওই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার ফলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়ার বৈধতা পায় অর্থাৎ কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল হয়।
পরদিন ৬ জুন কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। কোটা প্রথা বাতিলের একদফা দাবি জানাতে থাকে ছাত্ররা। পরে শেখ হাসিনার দম্ভক্তি, জেদ ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে অপমানজনক অবস্থানের কারণে আন্দোলন ধীরে ধীরে উত্তাপ ছড়াতে থাকে। আন্দোলন চলাকালে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের হামলা ও গুলিতে শতশত ছাত্র-জনতার মৃত্যুর পর আগস্টের শুরুতে এসে আন্দোলন রুপ নেয় সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে। পরে ৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাপত্র জমা দিয়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে শেষ হয় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ অধ্যায়ের।
আরও পড়ুন:
ঘটনাপ্রবাহ: যেভাবে পতন হয় স্বৈরাচার হাসিনার
শেখ হাসিনার পতন: ঘটনাবহুল ৫ আগস্ট সারাদিন যা যা ঘটে
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর ঢাকায় যা যা ঘটলো
পথে পথে ছাত্র জনতার উল্লাস