চলতি বছরের ৫ জুন যখন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দেয়, তখন কারো ধারণাই ছিলো না যে পরের দুই মাসের মধ্যে সেটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটবে। শেষ পর্যন্ত এটি শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের টানা শাসন অবসানের দিকে নিয়ে গেছে। সেদিন হাইকোর্টের সেই আদেশটি অনেক পত্রিকায় তেমন গুরুত্বও পায়নি। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ সপ্তাহের মাথায় সেই বিক্ষোভের জেরে এক সময় ১৬ বছর ধরে কঠোরভাবে বিরোধী দলকে দমন করে একটানা ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনাকে গোপনে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়। আন্দোলনটি শুরুতে ছাত্রদের কোটা সংস্কার কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এর সাথে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার, নানা বয়সের লাখো মানুষ অংশ নিতে শুরু করে।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগ যে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েছিল, প্রায় ৫০ বছরের মাথায় দলটি আবার সেই একই অবস্থায় পড়েছে। কিন্তু পুরো পরিস্থিতি কীভাবে এবং কেন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছালো, যাতে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটির বিরুদ্ধে এভাবে রাজপথে নেমে আসলো? কেন ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে থাকা শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হলো? তা জানার চেষ্টা করবো এই প্রতিবেদনে (বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুসারে)-
দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ:
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসনে জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর থেকে আর দলটি ক্ষমতা থেকে বের হতে চায়নি। একতরফা বা জালিয়াতির নির্বাচন, বিরোধীদের ও বিরুদ্ধ মত দমন, অনিয়ম আর দুর্নীতি, আমলা আর প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে দলটির টিকে থাকা এই পতনের পেছনে মূল কয়েকটি কারণ হিসেবে উঠে আসছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ১৫ বছরে বেশিরভাগ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তারা নিজেরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের যে ক্ষমতার ভিত্তি, তার কোনটাই টেকসই ছিল না। কারণ তারা জনগণ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে মানুষের একটা ক্যাটালিস্ট বা স্ফুলিংগের দরকার ছিল। সেটাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়েছে।
ফলে সরকার বিরোধী একটা আন্দোলন যখন জোরালো হয়ে ওঠে, সেই আন্দোলন ঘিরেও মানুষের ক্ষোভের জন্ম হয়, তখন সেনাবাহিনী, কারফিউ বা পুলিশের পরোয়ানা না করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার হাজার হাজার মানুষ গণভবনের উদ্দেশ্যে পথে নেমে এসেছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ”১৫ বছরের একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, জিনিসপত্রের দাম, গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা, লুটপাট, ব্যাংকিংয়ের অনিয়ম সব কিছু নিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ কোটা আন্দোলনের একটা উপলক্ষ্য করে একটা পরিবর্তনের আশায় নেমে এসেছে।”
ভোটের আর মতপ্রকাশের অধিকার:
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসলেও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ বাস্তবে কার্যত একটি ‘একনায়কতান্ত্রিক’ সরকারে পরিণত হয়েছিল। ২০০৮ সালের পর বাংলাদেশে বাস্তবিক অর্থে আর কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। এই সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের দুইটি হয়েছে অনেকটা একতরফা নির্বাচন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিলেও সেখানে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ ছিল, যে নির্বাচনকে ‘রাতের নির্বাচন’ বলেও অনেকে বর্ণনা করেন।
এমনকি স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ প্রভাব বিস্তার করেছে। সেসব নির্বাচনও বেশিরভাগ সময় একতরফা হয়েছে। যেখানে বিএনপি বা অন্য রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে, সেখানেই অনিয়ম বা কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। ফলে গত ১৫ বছরে মানুষ আসলে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি বেছে নেয়ার বা মতামত জানানোর কোন অধিকার পায়নি।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ”আওয়ামী লীগ যেটা করেছে, জোরজবরদস্তি করে একটা কতৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করলো। জনগণের কোন রায় তারা নেয়নি। ফলে জনগণের সমর্থনও ছিল না তাদের পেছনে। প্রশাসনকে ব্যবহার করে জবরদস্তি করে ভুয়া নির্বাচন করে তারা ক্ষমতায় ছিল।”
আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধী দলকে শক্ত হাতে দমন করার অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এসব দলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ শত শত নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে, মামলা বা সাজা দিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। অনেক নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ”যে দেশটা স্বাধীন হয়েছে মানুষের ভোটের অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে, সেই দেশে দীর্ঘ ১৫ বছরে মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করা হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ। তাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের আইন, নজরদারি করার মাধ্যমে।” বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পুলিশের অনুমতি ছাড়া প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে সভা সমাবেশও করতে দেয়া হয়নি।
মানবাধিকার হরণ ও ভয়ের সংষ্কৃতি:
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এ বছরের শুরুতেই জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক অভিযোগ করেছিলেন যে, মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, বিরোধী গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিরুদ্ধ মত দমন করা হয়েছে কঠোর হাতে। বিরোধী গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, দখল নেয়া হয়েছে অথবা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয়েছে।
বাংলাদেশে গত বহু বছর ধরে সামাজিক মাধ্যমেও শেখ হাসিনা বা শেখ মুজিব বিরোধী বক্তব্য পোস্ট করার জের ধরে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে। এই দমনের জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন করা হয়েছে। সরকার বিরোধী বক্তব্য দেয়ার জের ধরে মাসের পর মাস ধরে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে, জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, শেখ হাসিনার সরকার ও পুলিশ বাহিনী মিলে পুরো দেশকে একটা ‘মাফিয়া স্টেট’ তৈরি করেছিল। আর এসবের জন্য সবসময়েই সরকারি প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা বাহিনী এমনকি বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা হয়েছে।
যেসব মামলায় গত ১৬ বছরে জামিন হয়নি, সরকার পরিবর্তনের পর এক রাতের মধ্যে সেসব মামলায় জামিনে মুক্তি পেয়েছেন এসব রাজনৈতিক দলের শত শত কর্মী। জামিন দেয়ার সময় বিচারক মন্তব্য করেছেন, ”অনেক কথা আছে যা আমরা বলতে পারি না।” বছরের পর বছর বিরোধীদের ধরে নিয়ে হয় গুম করে দেয়া হয়েছে না হলে আটকে রাখা হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর এরকম কয়েকজন ব্যক্তি মুক্তিও পেয়েছেন, যাদের আট বছরের বেশি সময় ধরে কোন অভিযোগ ছাড়াই গোপনে আটকে রাখা হয়েছিল। ফলে মানুষ যে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি, ভয়ভীতির মধ্য দিয়ে সময় পার করেছে, তা থেকে মুক্তি পেতেই গণআন্দোলনে সবাই নেমে এসেছে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।
পুলিশ ও প্রশাসন নির্ভর একটি দল:
বিভিন্ন দেশের ইতিহাসেও দেখা গেছে, জোর করে ক্ষমতায় থাকা দল বা রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এক সময় আমলা, প্রশাসন বা পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। তাদের মতে, টানা বহুদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার ফলে এক সময়ের মাঠের রাজনৈতিক দল হলেও দলটির নেতা-কর্মীরা জনগণের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল দলটি। বিশেষ করে দলটি পুরোপুরি প্রশাসন ও আমলানির্ভর হয়ে উঠেছিল। দলের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব নেতাদের পদ দেয়া হতো, অভিযোগ রয়েছে যোগ্যতার বদলে বরং স্বজনপ্রীতি বা অর্থের বিনিময়ে এসব পদ দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক পদ বা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন অনেক ব্যক্তিকে সুযোগ দেয়া হয়েছে যাদের অতীতে রাজনীতির সাথে কোন সংস্রব ছিল না। তাদের অনেকেই এসব পদকে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করেছে। সাংবাদিকসহ পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে এমনভাবে দলীয় বিস্তার ঘটানো হয়েছে যাতে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আসল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। ।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ”গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র শক্তি ব্যবহার করতে করতে তাদের দলটাকে দুর্বল করে ফেলেছিলেন। অযোগ্য, অদক্ষ ব্যক্তিদের দলের শীর্ষ পদে বসানো হয়েছে। ফলে তাদের সব কিছু ছিল, কিন্তু দলটাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। প্রতিটি গ্রামেগঞ্জে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নামে, আওয়ামী লীগের নামে তাদের নেতাকর্মীরা যা করেছে, তাতে মানুষের ক্ষোভ জমতে জমতে এমন একটা অবস্থায় গেছে, এবার শুধু সেটার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। গুলিতে যখন অনেক মানুষ মারা গেছে, তখন তাদের গুলিতে মৃত্যুর ভয়ও চলে গেছে।
শুধু সাধারণ মানুষ নয়, যেসব বাহিনীর ওপর নির্ভর করে সরকার ক্ষমতায় টিকে ছিল, সেইসব বাহিনীর মধ্যেও অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। তাদের শীর্ষ পদগুলো থাকা ব্যক্তিরা যেমন এসব ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো বাহিনী পরিচালনা করেছেন, আইন বা নিয়মের ধার ধারেননি। তেমনি দুর্নীতির করে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে।
রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচনায় থানার ওসি থেকে শুরু করে কমিশনার পর্যন্ত নিয়োগ হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দলীয় সম্পৃক্ততার অভাবে অনেক কর্মকর্তা অবহেলিত থেকেছেন। এসব কারণে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর অনেকের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিরোধী একটি মনোভাব তৈরি হয়েছিল।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের অধস্তন কর্মকর্তাদের একটি বিজ্ঞপ্তিতে যেমন দাবি করা হয়েছে, ‘রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কাজে ব্যবহার করেছেন। বাধ্য হয়ে তাদের সেসব নির্দেশ মানতে হয়েছে।’
লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ”রাষ্ট্র আর দল একাকার হয়ে গিয়েছিল। দেশে এক ব্যক্তির শাসন, এক পরিবারের শাসন ছিল। সেটা পুরো রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে। সেখানে ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র, পুলিশ , মিলিটারি সব মিলিয়ে ছিল। সেখানে চিড় ধরায় তার ক্ষমতা তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়েছে।”
দুর্নীতি আর বেগমপাড়া:
আওয়ামী লীগের সরকার তাদের ইশতেহারে ও নেতাদের বক্তব্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা ঘোষণা করে আসলেও গত তিন মেয়াদে এই দলের ছোট থেকে কেন্দ্রের বেশিরভাগ নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ উঠেছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগরিটি (জিএফআই) হিসাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সেই হিসাবে ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থে কানাডায় বাংলাদেশিদের পরিবাবের সদস্যদের নিয়ে ‘বেগমপাড়া’ তৈরি হওয়ার মতো খবর এসেছে। অনেক নেতা-মন্ত্রী-এমপি, সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী দেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম তৈরি করেছেন, বিনিয়োগ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের মতো অনেক সরকারি সাবেক কর্মকর্তার হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ তৈরির খবর প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে। সরকারি অফিসে ঘুষ দেয়া যেন একটা স্বাভাবিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-মন্ত্রীর, সরকারি উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের দেশে বিদেশে বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ, বিনিয়োগ স্কিমে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নেয়ার মতো অভিযোগ উঠেছে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ”এতো দুর্নীতি হয়েছে, যা আগে কখনো মানুষ দেখেনি। দুর্নীতি নিয়ে মানুষের ভয়, চক্ষুলজ্জাও উঠে গিয়েছিল। এসবের মধ্য দিয়ে তারা যে বিত্ত অর্জন করেছে, তা পাচার করে দিয়েছে। যেখানে মানুষ কষ্টে জীবনযাপন করছে, সেখানে নেতা-মন্ত্রীদের বিদেশে অঢেল সম্পদের তথ্য মানুষকে বিরক্ত আর ক্ষুব্ধ করেছে।”
বেতনের তুলনায় দুর্নীতির সুযোগ থাকার জন্য সরকারি চাকরি এত লোভনীয় হয়ে উঠেছে যে চতুর্থ শ্রেণির চাকরির পেছনেও লাখ লাখ টাকা ঘুষ দেয়া-নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ”মানুষ ভালো চাকরি পেতে চেয়েছে, যাতে তারা অর্থনীতিকভাবে যাতে নিরাপদ থাকতে পারে। আগে প্রাইভেট সেক্টরে অনেক ভোলো চাকরি ছিল, সেই সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। ফলে তারা সবাই সরকারি চাকরি পেতে চাইছিল।” কিন্তু সেই চাকরির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও তারা নানা অনিয়মের মুখোমুখি হয়েছে।
‘অর্থনীতির দৈন্যদশা’র চাপ:
বাংলাদেশের গত দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে। রাতারাতি ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে সব কিছুর ওপরে। মানুষের সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম রাতারাতি বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে র্রিজার্ভের ঘাটতি, দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ পাচার, ব্যাংকিংখাতে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের একের পর এক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে দেশের গণমাধ্যমে।অথচ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠেছে। ফলে তাদের মধ্যে দিনে দিনে সরকার বিরোধী মনোভাব তৈরি করেছে।
আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদের সময় পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, টানেল, পায়রা বন্দর, পায়রা সেতু, রেল সংযোগের মতো বহু ব্যয়বহুল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছে। তাতে দক্ষিণবঙ্গের মতো অনেক স্থানে অর্থনৈতিক পরিবর্তনও এনেছে। কিন্তু সেই সাথে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়েছে।
শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রীরা বারবার এসব উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে গেলেও তার খুব বেশি প্রতিফলন নিজেদের সাংসারিক বা ব্যক্তি জীবনে তেমন একটা দেখছিলেন না সাধারণ মানুষ। ফলে তারাও একটি পরিবর্তন চাইছিলেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন, ”অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারা দেখিয়েছিল উন্নয়ন। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের জীবনে কোন পরিবর্তন হয়নি। এই উন্নয়ন ছিল ফাঁপা উন্নয়ন। কারণ তাতে কর্মসংস্থান হয়নি। উন্নয়নের ফল বিতরণও ঠিক মতো হয়নি। অল্পকিছূ মানুষ এর ফল ভোগ করেছে।”
সেই সাথে নেতাদের, সরকারি কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত সুযোগ- সুবিধা পাওয়া, দুর্নীতি-ঘুষ, ছোটখাটো ব্যবসায়ী- হকার থেকে শুরু করে সেবা নিতে যাওয়া প্রতিটি মানুষের ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে।
ব্যাঙ্কিংখাতে রাজনৈতিক যোগাযোগ ব্যবহার করে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে সর্বশ্রান্ত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। সেসবের জন্যও অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে।
কিন্তু এগুলোর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি, কাউকে জবাবদিহি করতে হয়নি। এগুলোর সব কিছুতে মানুষের ক্ষোভ জমেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ”এসবের বোঝা পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপরে, যাদের দ্রব্যমূলের ব্যয় বেড়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেসব দূর করতে সরকারের কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছিল না। মানুষ তাতেও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। তারা এসব কিছুর জন্য দায়ী করেছেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে।”
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, এসবের বাইরে ভারতের প্রতি সরকারের অতি নির্ভরতাও অনেকে পছন্দ করেনি বলে তিনি বলছেন। কারণ গত কয়েক বছরে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যেসব চুক্তি হয়েছে, বাংলাদেশের তুলনায় সেগুলো ভারতের জন্য বেশি সুবিধাজনক বলে সমালোচনা রয়েছে। ”ভারতের ওপর তাদের নির্ভরতা, যেসব চুক্তি করেছে, দেখা গেছে সেসব ভারতের পক্ষে যাচ্ছে। ঋণ বাড়ছে। নানা কারণে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছি,” বলছেন মি. চৌধুরী।
বাস্তবতা বুঝতে পারেননি হাসিনা:
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া একটি আন্দোলন আলোচনা বা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা না করে কেন সরকার গুলি-গ্রেফতারের মতো বলপ্রয়োগের পথে গেল, তা অনেককে অবাক করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’ মন্তব্যের জবাবে মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে, আমি কে- রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে যখন পথে নেমে আসে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘তাদের স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগ দেবে’।
এটা পরিষ্কার ছিলো যে, প্রথম থেকেই এই আন্দোলন নিয়ে কোন আলোচনার আগ্রহ বা নমনীয়তা দেখায়নি আওয়ামী লীগ। বরং আগের সব আন্দোলনের মতো শক্ত হাতে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথমে নিজেদের ছাত্র বাহিনীকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা, সেখানে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যদের দিয়ে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। বেপরোয়াভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাকশন, গুলি চালানোয় পাঁচ সপ্তাহে পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। পরিস্থিতি সামলাতে ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারি, সাধারণ ছুটি ঘোষণা করতে হয়েছে।
তারপরে যখন পরিস্থিতি খানিকটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে বলে মনে হয়েছে, তখন শত শত মামলা করে রাতের বেলা ব্লকরেইড দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে ধরে এনে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এমনকি রংপুরের আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনার পুলিশের গুলি করার ভিডিও থাকার পরেও পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপিয়েছে, নিরীহ এক শিক্ষার্থীকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছে।
ছয়জন সমন্বয়ককে হাসপাতাল ও বাড়ি থেকে ধরে এনে কোন কারণ না দেখিয়েই দিনের পর দিন গোয়েন্দা কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছে, তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বিবৃতি আদায় করা হয়েছে। কিন্তু কাউকে সেজন্য জবাবদিহিও করতে হয়নি। পুলিশ, বিজিবি ও দলীয় বন্দুকধারীদের গুলি করার ছবি ভিডিও থাকার পরেও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতারা ক্রমাগত অসত্য বক্তব্য দিয়ে গেছেন, বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন, আন্দোলনকারীদের হুমকি দিয়েছেন। এমনকি ‘পুলিশের পোশাক পরে সন্ত্রাসীরা গুলি চালিয়েছে’ এমন কথাও বলা হয়েছে সরকারি মন্ত্রীদের পক্ষ থেকে। ইন্টারনেট বন্ধ করা নিয়ে নানারকম বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া হয়েছে। এসব কিছুই মানুষের ভেতর ক্ষোভ তৈরি করেছে,তাদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
আন্দোলনের নেপথ্যে ‘জামায়াত-শিবির রয়েছে’ দাবি করে বরাবরই আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা বাস্তবতা অস্বীকার করে গেছেন। এমনকি এর জের ধরে তারা তড়িঘড়ি করে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধও ঘোষণা করে। এর বাইরে দেশি-বিদেশি মহলের ইন্ধন রয়েছে বলেও নানাসময় অভিযোগ তোলা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, একদিকে যেমন সরকার এর মধ্যে প্রতিপক্ষের ইন্ধন খুজেছে, তেমনি আন্দোলনেও তাদের প্রতিপক্ষরাও নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে, অংশ নিয়েছে। ফলে আন্দোলন ব্যাপকতা পেয়েছে, সংঘর্ষ-সহিংসতা সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। পরবর্তীতে সরকার আলোচনার কথা বললেও ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে এটা কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছাড়িয়ে জনমানুষের ক্ষোভের একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
শেখ হাসিনার ছেলে ও তার সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও বিবিসিকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কোটা আন্দোলন যে সরকার উৎখাতের দিকে গড়াবে, সেটি তারা কেউ ধারণা করতে পারেননি। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রথমদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের দাবিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব আমলে নেয়নি, তেমনি পরের দিকে এসব দাবির সাথে সাথে সাধারণ মানুষের দাবি মিশে গেছে, তারাও এর অংশ হয়ে উঠেছে, সেই বাস্তবতাও তারা বুঝতে পারেনি। পুরো পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের অবিবেচনা, ভুল সিদ্ধান্ত ও মন্তব্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
আওয়ামী লীগ ঘরানার বিভিন্ন সংগঠন, গণমাধ্যম ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরকারের সেসব অযৌক্তিক ও অবিবেচক সিদ্ধান্তে সমর্থন দিয়ে গেছে বলে বিশ্লেষকরা অভিযোগ করছেন। আওয়ামী ঘরানার লোকজন ও বিভিন্ন সংগঠন মিলে দিনের পর দিন সরকারকে নানা অযৌক্তিক অন্যায় কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে যে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করেছে, সেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন পরে সবার জন্য ধ্বংসের কারণ হয়েছে।