Dhaka Reader
Nationwide Bangla News Portal

রাঙামাটির জুরাছড়িতে সেনা সদস্য এবং পুলিশের মাঝে কী ঘটেছিল?

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন:
পার্বত্য জেলা রাঙামাটির জুরাছড়িতে একজন সেনা কর্মকর্তাকে ‘সম্মান না দেয়াকে’ কেন্দ্র করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে। এই ঘটনার জের ধরে জুরাছড়ি থানার ওসি ও কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বেধড়ক পেটানোর অভিযোগ উঠেছে সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে একজন সেনা সদস্যকে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। সেনা সদস্যকে মারধর করার প্রতিবাদে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালিদের সমন্বয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয় এবং তারপর জুরাছরি থানায় হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়।

সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র প্রতিষ্ঠান আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে রাঙামাটির জুরাছড়িতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির’ সৃষ্টি হয়। ঘটনার কারণ উদঘাটনের জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে একটি যৌথ তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে আইএসপিআর-এর তরফ থেকে জানানো হয়েছে। “তদন্ত শেষে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ঘটনাটি তদন্তাধীন থাকায় উস্কানিমূলক বক্তব্য ও গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সকলকে অনুরোধ করা হল,” বলা হয় আইএসপিআর-এর বিবৃতিতে।

জুরাছড়ির পাহাড়ি বাসিন্দা বলছেন, তাদের নাম প্রকাশিত হলে সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের দিক থেকে তারা হয়রানির শিকার হতে পারেন। অন্যদিকে, স্থানীয় বাঙালিরাও একই কথা বলছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার সূত্রপাত ২৭ অগাস্ট বিকেলের দিকে। সেনাবাহিনীর স্থানীয় জোন কমান্ডার জুরাছড়ি বাজারের পাশ দিয়ে যাবার সময় সেখানে তিনজন পুলিশ সদস্য রাস্তার পাশে চা পান করছিলেন। সে তিনজন পুলিশ সদস্য ছিলেন পাহাড়ি।

জোন কমান্ডার এ এলাকা অতিক্রম করার পর তার সাথে থাকা ফিল্ড স্টাফ পুলিশ সদস্যদের জিজ্ঞেস করেন, তারা জোন কমান্ডারকে সম্মান জানিয়ে সালাম দেয়নি কেন? তখন পুলিশ সদস্যরা বলেন, তারা কেন সালাম দেবেন? পুলিশ সদস্যরা তো সেনাবাহিনীর অধীনে কাজ করে না। একপর্যায়ে সেনা সদস্যের সাথে পুলিশ সদস্যদের ধস্তাধস্তি শুরু হয়।

সেখানে ঠিক কী হয়েছিল তা নিয়ে দুই রকমের ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, সেনা সদস্য আগে একজন পুলিশ সদস্যকে চড় মারেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, সেনা সদস্য চড় মারেনি বরং কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা সেনা সদস্যকে মারধর করেন।

ঘটনাস্থল থেকে ফিরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সেনা সদস্যরা আবার এসে তিনজন পুলিশ সদস্যকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন বিষয়টি দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রত্যক্ষদর্শী একজন বিবিসি বাংলাকে জানান, পুলিশ সদস্যদের যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তাদের মারধর করছিল সেনা সদস্যরা। এক পর্যায়ে সেনা সদস্যরা জুরাছড়ি থানার ওসিকেও রাস্তায় আটকে ফেলে বেধড়ক মারপিট করে।

“আমি ওসি সাহেবকে দেখছি সেনাবাহিনীর চেকপোস্টের পাশে বসে কানতেছে। তার গায়ের জামা ছিঁড়ে গেছে, জামা নেই বললেই চলে। খুব মারধর করছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী। আরেকজন ব্যক্তি জানান, “সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য জুরাছড়ি বাজারের আশপাশে বাড়ি ও দোকানে লুকিয়ে ছিল। আমাদের চাকমাদের বাড়িতে এবং গোডাউনে লুকিয়ে রাখা হইছিল কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে।”

রাঙামাটির বেশ কয়েকজন সাংবাদিক বিবিসি বাংলার কাছে অভিযোগ করলেন, এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে যাতে কোনো সংবাদ প্রকাশিত না হয় সেজন্য তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। এই চাপ সেনা কর্মকর্তাদের তরফ থেকে এসেছিল বলে তারা অভিযোগ করছেন।

গত ২৭ অগাস্ট রাঙামাটি থেকে পুলিশের একটি বেতার পাঠানো হয় ঢাকার রাজারবাগে পুলিশ লাইন্সে। সেখানে বলা হয়, ২৭শে অগাস্ট বিকেল পাঁচটার দিকে জুরাছড়ি থানার তিনজন চাকমা পুলিশ কনস্টেবল থানার পাশে যক্ষ্মা বাজারে চা পান করতে যান। ওখানে আর্মির সিও স্যার উনার পরিবারসহ ছিল। কিন্তু উক্ত কনস্টেবলগণ সালাম না দেয়ায় মারধরের শিকার হয় এবং ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। থানার ওসি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি রাঙামাটির পুলিশ সুপারকে অবহিত করে এবং পুলিশ সুপারের নির্দেশে ওসি সেনা ক্যাম্পে যান।

পুলিশের বেতার বার্তায় বলা হয়েছে, ওসি এবং তার সাথে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা সেনা ক্যাম্পের ভেতরে যেতে চাইলে ক্যাম্পের সামনে তাদের আটকে দেয়া হয় এবং সবাইকে মারধর শুরু করে এবং ওখান থেকে তারা পালিয়ে যায়। সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় জনগণ মিলে থানা এলাকা ঘেরাও করে এবং থানার সামনে আগুন জ্বালিয়ে দেয়,” পুলিশের বেতার বার্তায় এভাবে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য বিবিসি বাংলার তরফ থেকে রাঙামাটির ব্রিগেড কমান্ডারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। রাঙামাটি সেনানিবাস থেকে জানানো হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে একটি ‘কোর্ট অব এনকোয়ারি’ চলমান আছে। সেজন্য ব্রিগেড কামান্ডার জন্য বিষয়টিতে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে আইএসপিআর-এর সাথে বিবিসি বাংলার তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলে একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জুরাছড়ির ঘটনা নিয়ে বুধবার সেনা সদর থেকে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে তার বাইরে আপাতত আর কিছু বলার নেই।

রাঙামাটির একজন পুলিশ কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে এমনিতেই পুলিশ তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চেষ্টা করছে। তাছাড়া বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ সদস্য এবং কর্মকর্তাদের আতঙ্ক এখনো কাটেনি। এমন অবস্থায় জুরাইছড়ির ঘটনা আরেকটি পুলিশের মনোবলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

এই ঘটনার স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালীরা পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভে অংশ নেয়া একজন বাঙালি বলছেন, প্রায় পাঁচশর মতো মানুষ সেই বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছিল। তবে এই বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে। পাহাড়িদের কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেবার জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধ্য করেছিল।

স্থানীয় একজন পাহাড়ির ভাষ্য, “আমার পরিবারের সদস্যরা বিক্ষোভ মিছিলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। জোর করে মিছিলে নিয়ে গেছে। মাইর খাবার ভয়ে অনেকে মিছিলে গেছে।”

অন্যদিকে বাঙালিরা বলছেন, সেনাবাহিনী কাউকে বাধ্য করেনি। মানুষ স্বতস্ফূর্ত হয়ে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভকারীরা থানার গেটের সামনে আধাঘণ্টা মিছিল করে। তখন থানার সামনে সেনা সদস্যদের কড়া পাহারা ছিল।

স্থানীয়দের ভাষ্য, “সেনাসদস্যরা থানার সামনে এমনভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন যে ভেতরে কারো প্রবেশ করতে পারা রীতিমতো দুঃসাধ্য ছিল। দেয়াল যেভাবে তৈরি হয় ঠিক সেভাবে সেনাবাহিনী সদস্যরা থানার গেইটের সামনে ছিল।”

কিন্তু এক পর্যায়ে সেনা সদস্যরা থানার ভেতরে বিক্ষোভকারীদের ঢোকার সুযোগ তৈরি করে দেয় বলে উল্লেখ করছেন মিছিলে অংশ নেয়া একজন পাহাড়ি ব্যক্তি। অন্যদিকে স্থানীয় বাঙালিরা বলছেন, সেনাবাহিনী কাজটি ইচ্ছাকৃত করেনি। পরিস্থিতি এমন তৈরি হয়েছিল যে তাদের কিছু করার ছিল না। এই ঘটনা ঘটে রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মধ্যে।

স্থানীয় একজন বাঙালি ব্যবসায়ী বলেন, পুলিশ সদস্যরা যখন সেনা সদস্যকে মারধর করে তখন সেটি অনেকেই দেখেছে। তিনি বলেন, বাঙালি-পাহাড়ি সবাই মিলে একসাথে পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। পুলিশের ওপর অনেক আগে থেকেই ক্ষোভ ছিল জনগণের। ৫ই আগস্ট যখন সারা বাংলাদেশে থানা আক্রমণ হইছিল তখন এখানেও মানুষ চাইছিল থানা আক্রমণ করতে। কিন্তু সেনাবাহিনীর কারণে পারে নাই।

আরেকজন বলেন, আমরা এখানে যারা বাঙালি থাকি তারা সবাই ক্যাম্পের আন্ডারে থাকি। তারা আমাদের নিরাপত্তা দেয়। মানুষজন যখন থানায় প্রবেশ করে তখন সেখানে কোনো পুলিশ ছিল না। স্থানীয় বাসিন্দাদের মিছিলের আওয়াজ শুনে পুলিশ থানা থেকে পালিয়ে যায় বলে স্থানীয়রা বলছেন। পরে থানায় ঢুকে মানুষ ভাঙচুর চালায়।

ফেসবুকে আ. লীগের পক্ষে বট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়ানো হয় মন্তব্য

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবং পরে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিরোধী দলগুলোর ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়েছিল নানান মন্তব্য। এসব মন্তব্যের পেছনে কাজ করেছে বট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত ভুয়া ফেসবুক প্রোফাইল। এমন ১ হাজার ৩৬৯টি ফেসবুক প্রোফাইলের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে ২১ হাজারের বেশি মন্তব্য করা হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘ডিসমিসল্যাব’ হচ্ছে তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ। বৃহস্পতিবার গবেষণা প্রতিবেদনটি ডিসমিসল্যাবের ওয়েবসাইটে প্রকাশ হয়েছে।

বট নেটওয়ার্ক হলো একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, যেখানে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে কম্পিউটারভিত্তিকভাবে কাজ করা হয়। এটি নির্দিষ্ট কী-ওয়ার্ড ধরে বিভিন্ন পোস্ট বাছাই করে এবং সেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মন্তব্য পোস্ট করে। ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় দেখা গেছে, এই বট নেটওয়ার্কটি ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪৭৪টি রাজনৈতিক মন্তব্য করেছে।

গবেষণায় ১ হাজার ৩৬৯টি প্রোফাইল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ প্রোফাইলই ‘লকড’ বা ‘প্রাইভেট’ করা এবং প্রোফাইল ছবি নেই বা চুরি করা। এদের বেশির ভাগেরই বন্ধুসংখ্যা খুব কম বা নেই। এমনকি ৭০ শতাংশ প্রোফাইল ছবি অন্যদের থেকে চুরি করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের সহকারী অধ্যাপক নাঈমুল হাসান বট নেটওয়ার্কের কার্যক্রমকে কম্পিউটারভিত্তিক অপপ্রচারের একটি উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, “আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সংঘবদ্ধভাবে এই ধরনের কাজগুলো করা হচ্ছে।”

এই বট নেটওয়ার্কের অপব্যবহার প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে নির্বাচনকে ঘিরে এমন কর্মকাণ্ড প্রতিহত করা যায়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.