Dhaka Reader
Nationwide Bangla News Portal

মসজিদে নামাজ পড়ার সময় নিহত ৫০০ মুসল্লি, চারদিকে স্বজন হারানোর বেদনা

শুক্রবার সাগাইং-এ আজানের সাথে সাথে শত শত মুসলিম মধ্য মিয়ানমারের পাঁচটি মসজিদে ছুটে যান। পবিত্র রমজান মাসের শেষ হয়ে এসেছে। ঈদ উৎসবের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। তাই তারা রমজানের শেষ জুমার নামাজ আদায় করতে ছুটে যান মসজিদে। তারপর স্থানীয় সময় দুপুর ১২ টা ৫১ মিনিটে মারাত্মক ভূমিকম্প আঘাত হানে। তিনটি মসজিদ ধসে পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ছিল মায়োমা’তে। এর ভেতরে থাকা প্রায় সবাই মারা যান। শত শত কিলোমিটার দূরে থাই সীমান্তবর্তী শহর মায়ে সোতে মায়োমা মসজিদের সাবেক ইমাম সোয়ে নাইও ভূমিকম্পটি অনুভব করেন। পরের দিনগুলোতে তিনি জানতে পারেন যে, তার প্রায় ১৭০ জন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং তার প্রিয় সদস্য মারা গেছেন। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন মসজিদে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শহরে মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ছিলেন।

তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমি প্রাণ হারানো সব মানুষের কথা ভাবি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সন্তানদের কথাও। তাদের মধ্যে কিছু ছোট শিশুও আছে। এ বিষয়ে কথা বলতে বলতে আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারি না।”

মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সাগাইং এবং মান্দালয়ের কাছে সংঘটিত ভূমিকম্পে ২,৭১৯ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে মৃতদেহ উদ্ধার অব্যাহত রাখার সাথে সাথে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও এ অঞ্চলটি তার প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের জন্য পরিচিত ছিল, শহরগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠীও বাস করতেন।

সোমবার দেশটির সামরিক জান্তা মিন অং হ্লাইং-এর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মসজিদে নামাজ পড়ার সময় আনুমানিক ৫০০ মুসলিম মারা গেছেন। সাগাইংয়ের প্রত্যক্ষদর্শীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন যে, শহরের যে রাস্তায় মসজিদগুলো ছিল, সেই রাস্তা, মায়োমা স্ট্রিট, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাস্তার আরও অনেক বাড়িঘরও ধসে পড়েছে। শত শত মানুষ রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়েছে। হয় তারা এখন গৃহহীন অথবা ভূমিকম্পের পরে তারা বাড়িতে ফিরে যেতে ভয় পায়। রয়েছে খাদ্য সরবরাহের অভাব।

শুধুমাত্র মায়োমাতেই ধসে ৬০ জনেরও বেশি লোক চাপা পড়েন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে মায়োডাও এবং মোয়েকিয়া মসজিদে আরও অনেক লোক মারা গেছেন। মঙ্গলবারও আরও মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। সোয়ে নাই ও-এর মতে, মুসল্লিরা ভূমিকম্পের সময় পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। ২০২১ সালে সংঘটিত এক অভ্যুত্থানের পরপরই পালিয়ে এসে তিনি বর্তমানে স্ত্রী এবং কন্যার সাথে থাই শহর মে সোটে থাকেন।

তিনি বলেন, “প্রধান প্রার্থনা কক্ষের বাইরে, যেখানে মুসল্লিরা নিজেরা ওযু-গোসল করেন, সেখানে কিছু মৃতদেহ পাওয়া গেছে। কিছু মৃতদেহ অন্যদের হাত ধরে থাকতে দেখা গেছে, যা দেখে মনে হচ্ছে ভেঙে পড়া ভবন থেকে তাদের টেনে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছিল।” সোয়ে নাই ও যেসব প্রিয়জনকে হারিয়েছেন তাদের মধ্যে ছিলেন তার স্ত্রীর একজন চাচাতো ভাই।

তিনি বলেন, “তার মৃত্যু ছিল ইমাম হিসেবে ১৩ বছরের জীবনে ‘আমার সহ্য করা সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা। তিনিই আমাদের প্রতি তার সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা দেখিয়েছিলেন। পরিবারের সবাই তাকে ভালোবাসতেন। এই ক্ষতি আমাদের জন্য অসহনীয়।”

তার স্ত্রীর আরেক চাচাতো ভাই ব্যবসায়ী। তিনি মক্কায় হজ্জ পালন করেন। তিনিও মারা যান। সোয়ে নাই ও বলেন, “তিনি সবসময় আমাকে নি লে (বর্মী ভাষায় ছোট ভাই) বলে ডাকতেন। যখন আমি বিয়ে করি, তখন তিনি বলেছিলেন যে- আমরা এখন পরিবার এবং তিনি সবসময় আমাকে তার নিজের ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। আমাদের যখনই তার প্রয়োজন হতো, তখনই তিনি আমাদের পাশে দাঁড়াতেন। আমি যাদের ভালোবাসি, তাদের মতো ভাইদেরও হারিয়েছি।”

মারা যাওয়া ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে সোয়ে নে ও-এর সাবেক একজন সহকারী ইমামও আছেন। তাকে তিনি তার দৃঢ় কর্মনীতি এবং কুরআন তেলাওয়াতে অসাধারণ প্রতিভার জন্য স্মরণ করেন। স্থানীয় পাবলিক স্কুলের অধ্যক্ষ, যিনি মায়োমা মসজিদের একমাত্র মহিলা ট্রাস্টি ছিলেন, তিনিও মারা যান। সোয়ে নাই ও’ও তাকে একজন উদার মানুষ হিসেবে স্মরণ করেন। তিনি প্রায়ই নিজের পকেট থেকে মসজিদের কর্মসূচির জন্য অর্থ প্রদান করতেন। তিনি বলেন, “যখনই তিনি সম্প্রদায়ের অন্য কোনও ব্যক্তির মৃত্যুর কথা শোনেন, তখনই তিনি শোকের এক নতুন ঢেউ অনুভব করেন।”

রমজান মাসে তাদের মৃত্যু হয়েছে, এই বিষয়টি তিনি ভুলে যাননি। বলেন, “আমি বলব, সকলেই আল্লাহর ঘরে ফিরে গেছেন। সে অনুযায়ী তাদের শহীদ হিসেবে স্মরণ করা হবে।” ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মিয়ানমারের অন্যান্য অংশের মতো, এই সম্প্রদায়টি বিপুল সংখ্যক মৃতদেহের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে।

সামরিক জান্তা এবং প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চলমান লড়াইয়ের কারণে এটি জটিল হয়ে উঠেছে। সাগাইংয়ের মুসলিম কবরস্থানটি বিদ্রোহী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি এলাকার কাছাকাছি এবং বেশ কয়েক বছর ধরে তা জনসাধারণের জন্য বন্ধ রয়েছে। ভূমিকম্পের পর থেকে সেনাবাহিনী বৃহত্তর সাগাইং অঞ্চলের কিছু অংশে বোমাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে।

সোয়ে নাই ও-এর মতে, সাগাইং শহরের মুসলিম সম্প্রদায়কে তাদের মৃতদেহ মান্দালয়ে স্থানান্তর করতে হয়েছে, দুই শহরের সংযোগকারী একমাত্র সেতু ব্যবহার করে ইরাবতী নদী পার হতে হয়েছে। তাদের মৃতদেহ মান্দালয়ের বৃহত্তম মসজিদে দাফনের জন্য রেখে দেওয়া হচ্ছে। ইসলামিক রীতি অনুসারে মৃত্যু ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও তাদের দাফন করা হয়নি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.