সম্প্রতি বাংলাদেশে ছাত্র ও সাধারণ নাগরিকদের আন্দোলনেরর পর দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আকড়ে থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। পদত্যাগ করে সপরিবারে দেশ ছেড়ে পলায়ন করেন তিনি। ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলনের একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে পদত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমান ‘স্বৈরশাসক’ খ্যাত শেখ হাসিনা। এ ঘটনার পর দেখা যাচ্ছে সরকারবিহীন অবস্থায় দেশে ল’ এন্ড অর্ডার পরিচালনা করছে সেনাবাহিনী। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে দেশে আসলে সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছে নাকি গণ অভ্যুত্থান? এর উত্তর জানতে হলে আমাদেরকে পরিস্কারভাবে জানতে হবে এই বিষয় দুটি কি। তাদের মধ্যে পার্থক্য কি? আর গণঅভ্যুত্থানের পরে দেশে কিকি উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে তা নিম্নরূপ-
গণঅভ্যুত্থান এবং সেনা অভ্যুত্থান দুটি পৃথক ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ঘটনা, যা একটি দেশের সরকারের পরিবর্তন বা সরকারকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়।
গণঅভ্যুত্থান (Mass Uprising):
গণঅভ্যুত্থান হল যখন সাধারণ জনগণ, বড় সংখ্যায় সমবেত হয়ে, কোনো সরকার বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং তাদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করে। এটি সাধারণত একটি অগণতান্ত্রিক সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে এবং এতে অংশগ্রহণকারীরা গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার বা অন্যান্য সামাজিক পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করতে পারে। গণঅভ্যুত্থান সাধারণত গণতান্ত্রিক উপায়ে, যেমন মিছিল, ধর্মঘট, অবরোধ ইত্যাদির মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
সেনা অভ্যুত্থান (Military Coup):
সেনা অভ্যুত্থান হল যখন একটি দেশের সামরিক বাহিনী হঠাৎ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। এটি সাধারণত বিদ্যমান সরকার বা নেতাকে অপসারণ করে সামরিক আইন প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে করা হয়। সেনা অভ্যুত্থান সাধারণত শান্তিপূর্ণ নয় এবং এটি একটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বা প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থার উপর আঘাত হানে। সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী বা এর সমর্থিত কোনো গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে এবং সাধারণত দেশের আইন ও সংবিধানকে স্থগিত করে।
এই দুইটি ঘটনার প্রধান পার্থক্য হলো গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ জনগণ প্রধান ভূমিকা পালন করে, যেখানে সেনা অভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনী প্রধান ভূমিকা পালন করে।
গণঅভ্যুত্থান সফল হলে পরে কি পদক্ষেপ নিতে হবে-
গণঅভ্যুত্থান সফল হলে, দেশ ও জনগণের স্থিতিশীলতা, সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সফল গণঅভ্যুত্থানের পর কার্যকর পদক্ষেপগুলি হল-
- অস্থায়ী সরকার গঠন: অবিলম্বে একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা প্রয়োজন, যা সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্থায়ী সরকার গঠনের ব্যবস্থা করবে। অস্থায়ী সরকার সাধারণত নিরপেক্ষ ব্যক্তি বা দল থেকে গঠিত হয়।
- নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা: একটি বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে সকল নাগরিকের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার অধিকার থাকবে। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ করা প্রয়োজন।
- আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন এবং আইন ও শাসনের প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি কার্যকর বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যা নিরপেক্ষভাবে ন্যায়বিচার প্রদান করবে।
- সংবিধান সংশোধন বা নতুন সংবিধান প্রণয়ন: যদি প্রয়োজন হয় সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে বা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে; যাতে জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়।
- গণমানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা: জনগণের মতামত এবং চাহিদাগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সুশীল সমাজের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও পুনরুদ্ধার: অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা এবং জনগণের জীবিকার উন্নতির জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
- প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সংস্কার: প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা সংস্থার মধ্যে শৃঙ্খলা এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা, যাতে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
- জাতীয় সংহতি ও পুনর্মিলন: সমাজের সকল স্তরের মধ্যে সংহতি ও পুনর্মিলন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে, যাতে অতীতের ক্ষোভ ও বিভাজন দূর করা যায়।
এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল এবং সুশাসিত সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।