‘উগ্রবাদের শঙ্কা’ নিয়ে প্রতিবেদন: বাংলাদেশের সরকারের প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষকদের মন্তব্য
ঢাকা রিডার, ৩ এপ্রিল ২০২৫: ‘উগ্রবাদের শঙ্কা’ নিয়ে প্রতিবেদন: ২০২৫ সালের ১ এপ্রিল, দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা নিয়ে দেশটির সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে। প্রতিবেদনটির বিষয়বস্তু এবং এর প্রকাশের পর বাংলাদেশে রাজনীতি, সমাজ এবং গণমাধ্যমের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। প্রতিবেদনটি মূলত বাংলাদেশে উগ্রবাদের উত্থান এবং ইসলামী কট্টরপন্থিরা দেশটির বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন সুযোগ দেখছে এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করেছে।
‘উগ্রবাদের শঙ্কা’ নিয়ে প্রতিবেদন: উগ্রপন্থি গোষ্ঠীগুলোর উত্থান এবং সরকারী ভূমিকা:
প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘অ্যাজ বাংলাদেশ রিইনভেন্টস ইটসেলফ্, ইসলামিস্ট হার্ড লাইনারস্ সি অ্যান ওপেনিং’, যার বাংলা অর্থ হল- “যখন বাংলাদেশ নতুন রূপে গড়ে উঠছে, তখন ইসলামী কট্টরপন্থিরা নতুন সুযোগ দেখছে।” প্রতিবেদনটির মাধ্যমে বাংলাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেখানে নারী বিদ্বেষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি হামলা এবং ইসলামী গোষ্ঠী আহমদিয়াদের ওপর আক্রমণের মতো বিষয়গুলোর প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটি সঠিকভাবে দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরতে ব্যর্থ বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে সরকারের বিরুদ্ধে নমনীয়তার অভিযোগ তোলা হয়েছে এবং উগ্রপন্থিরা সুযোগ নিতে প্রস্তুত রয়েছে এমন ধারণা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের প্রকাশের পর, বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে ‘বিভ্রান্তিকর এবং একপেশে’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া: প্রতিবেদনকে বিভ্রান্তিকর আখ্যায়িত
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তা ‘বিভ্রান্তিকর’ এবং ‘একপেশে’ বলে উল্লেখ করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অতিরঞ্জিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং ১৮ কোটি মানুষের দেশটিকে অবিচারপূর্ণভাবে কলঙ্কিত করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়, তারা নারীর উন্নয়নে প্রচুর পদক্ষেপ নিয়েছে এবং দেশকে একটি উগ্রপন্থি পরিস্থিতিতে ফেলতে দেবেন না।
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী দাবি করেন যে, বাংলাদেশে উগ্রবাদের উত্থান ঘটেনি এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, “দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক এবং তা আরও উন্নতির দিকে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।” একই দিনে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও বলেন, “বাংলাদেশে চরমপন্থার সুযোগ তৈরি হতে দেওয়া হবে না। আমরা চেষ্টা করব বাংলাদেশে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় উগ্রপন্থার মাথাচাড়া দিতে না পেরে।”
বাংলাদেশে নারীবিদ্বেষ এবং উগ্রপন্থির উত্থান
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা বাংলাদেশে উগ্রপন্থি গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রমের প্রতি যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে ওড়না পরার কারণে হেনস্তা করার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া মোস্তফা আসিফ অর্ণবকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার পর তাকে সমর্থন জানিয়ে কিছু লোক তাকে কোরআন হাতে দিয়ে, মাথায় পাগড়ি এবং গলায় ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে। এই ধরনের ঘটনা নারীদের প্রতি সহিংসতা এবং মব সংস্কৃতির উত্থানের প্রতিফলন হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
এছাড়া, কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীর দ্বারা শো-রুম উদ্বোধনে বাধা দেওয়া, অনুষ্ঠান পণ্ড করার মতো ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার পর, সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে, কিছু নারী বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে তারা নিরাপদ বোধ করছেন না।
প্রতিবেদন এবং সরকারের সমালোচনা: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী মনে করেন, “সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনকে ‘মিসলিডিং’ আখ্যায়িত করা ঠিক নয়। এই ধরনের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন না করে প্রতিবাদপত্র পাঠানোর সুযোগ রয়েছে।”
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, “বর্তমান সরকারের সময়কালে বাংলাদেশে তিনটি প্রবণতা স্পষ্টভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে—মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা, নারীর প্রতি বিদ্বেষ এবং ডানপন্থার উত্থান।” তিনি বলেন, “এই প্রবণতাগুলো আগেও ছিল, কিন্তু এখন অনেক স্পষ্টভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।”
সরকারের কার্যকর ভূমিকা এবং ভবিষ্যত প্রতিক্রিয়া
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, তারা উগ্রপন্থা সামাল দিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো এই বিষয়ে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষ করে, ‘তৌহিদী জনতা’ নামে একটি ইসলামী গোষ্ঠীর আন্দোলন, নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া এবং মাজারে ভাঙচুরের মতো ঘটনা সরকারের কর্তৃত্বের প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখিত হিযবুত তাহ্রীরের কর্মসূচি এবং সরকারী বাহিনীর প্রতিক্রিয়া, যেমন, ৭ মার্চ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে তাদের মিছিল টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে ছত্রভঙ্গ করা, উগ্রপন্থির উত্থানের একটি বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যম এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা: সরকারের অবস্থান
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর, বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। কিছু ব্যবহারকারী প্রতিবেদনটির তথ্যের সাথে একমত হন এবং সরকারের পদক্ষেপকে যথেষ্ট শক্তিশালী বলে মনে করেন না, অন্যদিকে কিছু ব্যবহারকারী মনে করেন প্রতিবেদনটির তথ্যগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, “সরকারের বিরুদ্ধে নমনীয়তার অভিযোগ অমূলক নয়। সরকারের ভূমিকা এ ধরনের পরিস্থিতিতে যথাযথভাবে প্রত্যাশিত নয়।”
অন্যদিকে, সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমকে ম্যালাইন করার কোনো এখতিয়ার নেই। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করতে পারে।”
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে, এবং সরকারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থার উত্থান এবং সরকারের নরম অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, তারা উগ্রপন্থা প্রতিহত করতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আরও আলোচনার সুযোগ তৈরি করবে।