ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় আয়োজিত আনন্দ মিছিলের অন্যতম চমক ছিল নাসিরুদ্দিন হোজ্জার বিশাল আকৃতির পাপেট। ঐতিহাসিক সুলতানি ও মুঘল আমলের নানা ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তুলতে আয়োজিত এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় গাধার পিঠে বসা লোককথার জনপ্রিয় চরিত্র নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটি পাপেট বিশেষভাবে নজর কাড়ে। তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই পাপেটটি নিয়ে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
সোমবার আনন্দ মিছিল শেষে সামাজিক মাধ্যমে ছবিটি ছড়িয়ে পড়তেই এটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কেউ কেউ এটিকে মিছিলে যুক্ত করার জন্য আয়োজকদের প্রশংসা করেন, আবার অনেকে প্রশ্ন তোলেন, ঈদের আনন্দের সঙ্গে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মিল কোথায়? আরও বড় বিতর্কের জন্ম দেয় একদল ব্যবহারকারীর দাবি, যেখানে তারা বলেন, এই পাপেটটি দেখতে অনেকটা জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের মতো।
পাপেটের নকশা ও বিতর্ক:
এ নিয়ে বিতর্ক বাড়তে থাকলে পাপেটটির মূল শিল্পী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক জাহিদুল হক জানান, এটি একটি আরবি বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, “নাসিরুদ্দিন হোজ্জা ও জামায়াত আমির একই ব্যক্তিত্বের লোক নন। হয়তো পোশাকের কারণে কিছু মিল পাওয়া গেছে, তবে এটি নিছক কাকতালীয়।”
তিনি আরও জানান, পাপেট তৈরির সময় শিশুদের বিনোদনের বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আরব্য রজনীর গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নানা চরিত্রের পাপেট শোভাযাত্রায় যুক্ত করা হয়, যার মধ্যে ছিল আলাদীন, আলী বাবা-চল্লিশ চোর ও নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মতো জনপ্রিয় চরিত্র।
ঈদ আনন্দ মিছিলের বৈচিত্র্য:
সোমবার সকালে ঢাকার শেরে বাংলা নগরের পুরনো বাণিজ্য মেলার মাঠে ঈদুল ফিতরের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়। জামাত শেষে সেখান থেকেই শুরু হয় বর্ণাঢ্য ঈদ আনন্দ মিছিল। আগারগাঁওয়ের প্রধান সড়ক হয়ে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় গিয়ে মিছিলটি শেষ হয়।
এই আনন্দ মিছিল ছিল অত্যন্ত বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময়। মিছিলে দুই সারিতে সাজানো আটটি সুসজ্জিত ঘোড়া, ১৫টি ঘোড়ার গাড়ি, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীকসহ ১০টি পাপেট শো ছিল।
মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা নানা ইসলামী সঙ্গীতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেচে-গেয়ে আনন্দ করেন। ব্যান্ডদলের বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’ সহ বিভিন্ন ইসলামী গান বাজানো হয়, যা দর্শকদের বাড়তি উচ্ছ্বাসে ভাসায়।
আয়োজকদের বক্তব্য:
উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “বাংলা সাহিত্যেও নাসিরুদ্দিন হোজ্জা চরিত্র এসেছে। এটি একটি মেটাফোরিক ক্যারেক্টার। বাচ্চারা এসব পছন্দ করে। যে কারণে এটাকে আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।”
তিনি আরও বলেন, “পুরো এই আয়োজনটিকে ঢাকাবাসী ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। এটাকে সমালোচনার চোখে না দেখে সংস্কৃতির একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ হিসেবে দেখা উচিত।”
সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে এমন আয়োজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাংলাদেশের বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক চর্চারই অংশ।”
নতুন মাত্রার ঈদ উদযাপন:
এ বছর রাজধানীতে ঈদ উদযাপনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন সংযোজন দেখা গেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এই প্রথমবারের মতো শিল্পকলা একাডেমিতে চাঁদরাত উৎসব আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে বর্ণাঢ্য ঈদ আনন্দ মিছিলও নজর কেড়েছে।
ঈদ উৎসবের এমন উদ্যোগ অনেককে উচ্ছ্বসিত করেছে। আয়োজকরা বলছেন, এটি ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে আয়োজন করা হবে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, এই আয়োজন তাদের জন্য ঈদের আনন্দকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
নাসিরুদ্দিন হোজ্জার পাপেট নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এটি শিশুদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অনেকেই এটিকে নিছক কাকতালীয় বলে দেখছেন, আবার কেউ কেউ বিতর্কের সুযোগও নিচ্ছেন। তবে আয়োজকদের বক্তব্য স্পষ্ট—এটি শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য তৈরি করা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার জন্য নয়।